একটি চিঠি ও গণতন্ত্রের সৌকর্য

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ছবি: রয়টার্স

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বব্যাপী, বিশেষত আমাদের দেশে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর থেকেই অঙ্গরাজ্য অনুযায়ী ফলাফল ঘোষণা হতে থাকে। বিভিন্ন সময় জোনের কারণে ভোটকেন্দ্র বিভিন্ন সময় বন্ধ হলেও নির্বাচনের দিন শেষ রাতেই কোন প্রার্থী বিজয়ী হবেন, সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় এবং ভোটের প্রবণতার ভিত্তিতে যে প্রার্থী ২৭০ বা এর বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন, তা নিশ্চিত করে সংবাদমাধ্যমগুলো সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে থাকে। সাধারণভাবে এ ধরনের ঘোষণার পর বিজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানান এবং ক্ষমতার পালাবদলের কাজ শুরু হয়।

কিন্তু এবারের নির্বাচনে তা ঘটেনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের আগেই আভাস দিয়েছিলেন তিনি পরাজয় মেনে নেবেন না। সে অনুযায়ী পরাজয় আঁচ করতে পেরেই তিনি ভোট কারচুপির অভিযোগে ফলাফল বাতিল, পুনর্গণনা, ঘোষণা বাতিল ইত্যাদি দাবি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। সেসব দাবির পক্ষে প্রমাণ ও ভিত্তি না থাকায় আদালত মামলা নাকচ করে দেন। আদালতের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সংস্থাগুলো নির্বাচনের চার দিন পর ৭ নভেম্বর ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনকে সম্ভাব্য বিজয়ী বলে ঘোষণা করে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী বলে দাবি করে মামলা চালিয়ে যেতে থাকেন। ফলে ক্ষমতার পালাবদলে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক একটি চিঠিতে সে অচলাবস্থা কেটে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চিঠির লেখক

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে (২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট) চিঠিটি লিখেছেন এমিলি ডব্লিউ মারফি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ সেবা প্রশাসনের প্রশাসক। তাঁকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনোনয়ন প্রদান করেন এবং মার্কিন সিনেট তা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করে। সংস্থাটি মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী স্থির হলে শপথ গ্রহণের আগে পর্যন্ত ব্যবহারের জন্য বিজয়ী প্রার্থীকে অফিস, আর্থিক ও অন্য সুবিধাদি প্রদান করে থাকে। এ সত্যায়নপত্র ক্ষমতার পালাবদলের সূচনা বলে বিবেচিত হয়।অবশেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ২০ দিন পর গত ২৩ নভেম্বর মারফি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনকে পত্রটি দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম কর্তৃক বিজয়ী, অঙ্গরাজ্যগুলোর ফলাফল ঘোষণা ও বিভিন্ন আদালতে কারচুপির মামলা প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও সত্যায়নপত্রটি প্রদানে বিলম্বের জন্য মারফির কঠোর সমালোচনা হয়।

চিঠিতে কী আছে

মারফি লিখেছেন যে তিনি প্রেসিডেনশিয়াল ট্রানজিশন অ্যাক্ট ১৯৬৩ অনুযায়ী নির্বাচনের পর ক্ষমতার পালাবদলে সহায়তার জন্য কিছু সেবা ও আর্থিক বরাদ্দ দিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। ‘আমি এ দায়িত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করি ও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যয়ন বিষয়ে মামলা চলতে থাকায় অতঃপর আমি আজ এ পত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলে সহায়তার জন্য কিছু সেবা ও আর্থিক বরাদ্দ আপনাকে প্রদান করছি।’

তিনি আরও লিখেছেন, আইন ও বাস্তবতার নিরিখে কোনো রকম নির্বাহী প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনলাইন, ফোন ও চিঠিতে যথাসময়ের আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, তাঁকে, তাঁর পরিবার, অধীন কর্মচারী, এমনকি পোষা প্রাণীকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘এ ধরনের হাজার হুমকি সত্ত্বেও আমি আইনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছি। আমার সংস্থা নির্বাচনে বিজয়ী নির্ধারণ করে না কিংবা নির্বাচনী বিরোধ বা এ-সংক্রান্ত মামলায় এর কোনো ভূমিকা নেই। আমি মনে করি না যে সরকারি ক্রয় ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের সংস্থা সাংবিধানিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে। এ জন্য সংবিধান, ফেডারেল ও অঙ্গরাজ্যের আইন আছে। তবে আমি মনে করি, এ প্রক্রিয়া ত্রুটিমুক্ত ও সুস্পষ্ট নয়, আমি কংগ্রেসকে এ–সম্পর্কিত আইন সংশোধনের আহ্বান জানাই।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চতর পদে পেশাদার দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকার বদল হলেই আবার তাঁরা নিজ কর্মস্থলে ফিরে যান। তা সত্ত্বেও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁরা নিয়োগকর্তার চেয়ে সংবিধান ও আইনের প্রতি বেশি অনুগত থাকেন। তাই এ ক্ষেত্রে মারফির নিয়োগকর্তা প্রেসিডেন্ট নিজেকে নির্বাচিত দাবি করলেও, মামলা চালু রাখলেও মারফি তাঁর আইনি দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। একদিকে নিয়োগকর্তা ও তাঁর দলের দাবি, অন্যদিকে বিরোধীদের হুমকি—দুটোই উপেক্ষা করে তিনি আইনি দায়িত্ব পালন করেছেন বলে তাঁর দাবি।

তবে মারফির পত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা প্রচেষ্টা আছে। অনেকেই মনে করেন, তিনি তাঁর মনোনয়ন প্রদানকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছেন এবং শেষমেশ বাধ্য হয়ে এই প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। এটাও বলা হয়েছে যে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ মার্ক মেডোসের নির্দেশে তিনি এ পত্র দিয়েছেন। প্রকারান্তরে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্মতি পাওয়ার পরই প্রত্যয়নপত্রটি দেওয়া হয়েছে। মারফির নীতি ও নিয়মনিষ্ঠা বা বাধ্য হয়ে যে কারণেই প্রত্যয়নপত্রটি দেওয়া হোক না কেন, চিঠিটি গণতন্ত্রের সৌকর্য তুলে ধরেছে।

প্রতিষ্ঠান, বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতন্ত্র

গণতন্ত্র বলতে আমাদের দেশে আমরা কেবল রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বুঝে থাকি। কিন্তু স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ না থাকলে গণতন্ত্র অকার্যকর। প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নিরপেক্ষ প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, আদালত ও সংবাদপত্র। নির্বাচনের আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষে ঘোষণা দেওয়া হয় যে নির্বাচনের ফলাফল কার্যকর করার ক্ষেত্রে তারা কোনো ভূমিকা রাখবে না। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষাপ্রধান আরও ঘোষণা দেন যে তাঁরা কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। কেবল সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন নয়, বিচার বিভাগও চূড়ান্ত নিরপেক্ষতার পরিচয় দেন। ভাবা হচ্ছিল যে যেহেতু সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, তাঁরা ট্রাম্পকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য রায় দেবেন। নির্বাচনের দিন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক কেবল কিছু ভোট আলাদা করার নির্দেশ দেন, যা নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেনি।

সবচেয়ে উল্লেখ্য বিষয় ছিল অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সেখানকার প্রশাসন ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা। পেনসিলভানিয়ায় বিচারক একসময় রিপাবলিকান পার্টির আধিকারিক ছিলেন, তিনি প্রমাণের অভাবে ভোট কারচুপির অভিযোগ কেবল নাকচ করেননি, বরং এ জন্য কৌঁসুলিদের তিরস্কার করেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে, যেমন জর্জিয়া ও নেভাদায় রিপাবলিকান গভর্নর ও অন্য আধিকারিকেরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সমালোচনা সত্ত্বেও নির্বাচনে কারচুপির অজুহাত নাকচ করে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীর বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি রিপাবলিকান পার্টি নিয়োজিত ক্যানভাসাররাও প্রেসিডেন্ট ও দলের চাপ সত্ত্বেও দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মিশিগানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীর বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছেন।

সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকাও প্রশংসনীয়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ভুয়া’ বলে আখ্যায়িত করলেও তারা তাদের করণীয় বিষয়ে অবিচল থাকে। ফক্স নিউজ, যা ট্রাম্পের সমর্থক বলে পরিচিত, তারাও অ্যারিজোনায় ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীকে সম্ভাব্য বিজয়ী ঘোষণা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো তারাও ৭ নভেম্বর জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী বলে ঘোষণা করে।

আগামী ২০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করবেন। এর মধ্যে আরও অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো গণতন্ত্রের জন্য আশাব্যঞ্জক। সে দেশের বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসন, আদালত ও সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র সুরক্ষায় যে অবদান রেখেছে, তা অনুকরণীয়। বিশেষ করে দল থেকে নির্বাচিত গভর্নর ও অন্য কর্মকর্তারা যেভাবে সংবিধান ও আইনকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখেছেন, তা বিস্ময়কর। জয়তু গণতন্ত্র!

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ

[email protected]