একটি জঙ্গল বানানোর স্বপ্ন

সাদামাটা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি আমরা। ঘরের চালে বাঁশের ঝোপ বেয়ে উঠেছে রসুন্দি, থানবার্জিয়া, মালতীসহ নানান জাতের লতা। তবে একটি লতাও মাটিতে লাগানো নেই। বিশাল আকৃতির গুড়ের মটকার ভেতর বড় হচ্ছে লতাগুলো। কিন্তু এসব গাছ এখনো কেন মাটিতে লাগানো হয়নি, জানতে চাইলে এই জঙ্গলের বয়নশিল্পী যায়েদ আমীন বললেন, ‘গাছগুলো আরেকটু ভালোভাবে সেট হোক।’ যথার্থ উত্তর। নাহলে গাছগুলো মরেও যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই বাগানে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে তিনি কিছু নিজস্ব দর্শনও কাজে লাগাচ্ছেন বলে মনে হলো।

এটা ছিল সূচনা মাত্র। ভেতরে যেতে যেতে অসংখ্য গাছপালার ঠাসবুনন আমাকে রীতিমতো চমকে দিল। যায়েদ আমীন পাগলের মতোই গাছ লাগিয়েছেন। লতাপাতা, তৃণগুল্ম, ঘাস, জলজ, ফার্ন, অর্কিড—কী নেই সেখানে। সপ্তাহান্তে তাঁর কাজ একটিই, গাড়িভর্তি গাছ এনে এখানে লাগানো।

আমরা সরু পথ ধরে ক্রমেই ভেতরে যাচ্ছি। চারপাশে চোখ রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মালিকানা পরিবর্তনের আগে জায়গাটি বিরান হয়ে উঠেছিল। দু–চারটি মেহগনি আর গুটিকয় বাঁশঝাড়ই বিলুপ্ত শালবনের প্রতিনিধিত্ব করছিল। এদিকটা বেশ নির্জন। চারপাশে একধরনের বুনো নিস্তব্ধতা। শুধু পাখির কলকাকলি শোনা যায়। প্রায় মাঝখান বরাবর এলে বাঁ দিকে অথবা সোজা দুদিকেই টিলা থেকে নিচে নেমে আসা যায়। কিন্তু সোজা এসে টিলা থেকে ঢালুতে নেমে খানিকটা ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। টলটলে জলের একটি জলজ্যান্ত নদী! বেশ প্রশস্তও বটে। আমার উচ্ছ্বাস দেখে যায়েদ আমীন বললেন, এটা শীতলক্ষ্যা। নারায়ণগঞ্জের দিকে কালো পানির যে শীতলক্ষ্যা দেখি, তার সঙ্গে তো এর কোনো সাদৃশ্য নেই। নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি বিরান ভিটা চোখে পড়ল। পরিত্যক্ত মাটির ঘর, চাপকল, মাটির চুলা, ছড়ানো–ছিটানো আরও কিছু জিনিসপত্র। মন খারাপ করার মতো দৃশ্য। একদিন এখানে অনেক প্রাণের স্পন্দন ছিল, ছিল কোলাহল। এখন কোথায় তারা?

দুপুরে তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে আমরা নদীতে নামি। এই নদীতে না নামলে বুঝতেই পারতাম না শীতলক্ষ্যার পানি কতটা স্বচ্ছ হতে পারে। কারণ, আমরা সাধারণত নদীটির কালো পানি দেখেই অভ্যস্ত। নদীর পাড়ে অসংখ্য বুনো ঝোপঝাড় লতাগুল্মের ঠাসবুনন। বেশির ভাগই অচেনা। এসব গাছে বসন্ত থেকে বর্ষা অবধি নানান রঙের ফুলও ফোটে।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালে প্রথম যখন এখানে আসি, তখন গাছগুলো অনেক ছোট, সংখ্যায়ও কিছুটা কম। তারপর দুর্লভ গাছের সন্ধানে প্রতিবছরই এখানে কয়েকবার এসেছি। ২০০৭ সালের দিকে সেখানে গাছ লাগানোর কাজ শুরু হয়। প্রায় ১০ বছরের ব্যবধানে জায়গাটি এখন সত্যিকার অর্থে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এবার বনের ভেতরে থিতু হওয়া গাছগুলোর পরিচয় জানানো যাক। যায়েদ আমীনের সীমানায় পৌঁছানোর পরপরই বাঁ দিকে চোখে পড়বে দুর্লভ সাদা চাঁপা, মাধবীলতা, কনকচাঁপা, কোকো ফল, কুমারীলতা, আমলকী, জলপাই, বকুল, মধুমঞ্জরি লতা, চামেলি, অশোক, পায়লাগোটা, মহুয়া, অ্যাভোকাডো, তুঁত, তমাল ইত্যাদি। ডানে অপরাজিতা, স্থলপদ্ম, নানান জাতের হ্যালিকুনিয়া, গুলগুলি লতা, চই, লং, নীল বনলতা, কপসিয়া, রুদ্র পলাশ, কয়েক জাতের বুনো মরিচ, দেশি লেবু। অপেক্ষাকৃত বড় গাছগুলোতে লাগানো হয়েছে বিচিত্র ফার্ন, গোলমরিচ, অর্কিডসহ অন্যান্য পরজীবী। মধ্যবর্তী স্থানে আছে শিউলি, পাতাবাহার, নতুন কাঞ্চন, জহুরিচাঁপা, গুস্তাভিয়া, ক্যাকটাস, হাইড্রেনজিয়া, বিচিত্রবট, সমুদ্রআঙুর, ঘৃতকুমারী, পাথরকুচি, ড্রাসিনা, বামুনহাটি, মানিপ্লান্ট, লাল ঝুমকো, পিচন্ডি, জেট্রফা, কেয়া, হিং বা জ্যাকুইনিয়া, শিবঝুল, লাল সোনাইল, বাঁশপাতা, গায়নুরাসহ আরও কত কী! শুধু এসবই নয়, বিভিন্ন মৌসুমে এখানে প্রাকৃতিকভাবেও আরও কিছু ফুল ফোটে।

বাগানবাড়ি নামের এই সংক্রামক ব্যাধি থেকে আমাদের ধনিক শ্রেণিকে বেরিয়ে আসতে হবে। নামে–বেনামে শালবনের জায়গা দখল করে নব্য ধনীরা যেভাবে বাগানবাড়ি ও কারখানা নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন, তাতে বিপন্ন শালবন অচিরেই বিলুপ্ত হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিষয়টি একটু ভিন্নভাবেও তো দেখা যায়। ক্রয় বা দখল করা জায়গাটি সাফসুতরো না করে রেখে দিন না প্রাকৃতিকভাবে। তার সঙ্গে চেষ্টা করুন আরও কিছু গাছ লাগাতে। একসময় শালবনে ছিল এমন কিছু গাছ। তাহলে শালবন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সম্মিলিত এমন চেষ্টাই কেবল শালবনসহ আমাদের সব বনকে সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে।

আমাদের অজান্তে হয়তো আরও অনেকেই নানাভাবে শালবন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে যায়েদ আমীন আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারেন। ইচ্ছা করলে তিনিও জায়গাটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন। ব্যক্তিগত বিনোদন বা আয়-রোজগারের কথা ভাবতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে গাছের পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। দেদার সময়ও দিয়েছেন। কিন্তু কিসের আশায়? বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।