একটি ভাষণের তাৎপর্য

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পেলেও জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় পৌনে তিন বছর। এই বিলম্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার দায়ী নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দায়ী। জাতিসংঘের সদস্যপদপ্রাপ্তি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা।

১৯৭২ সালের প্রথম কয়েক মাসেই বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্বীকৃতি পায়। ওই বছরই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদনের অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহাইমের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদের সব দায়বদ্ধতার প্রতি সুদৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ এবং সংস্থার বাধ্যবাধকতা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুগোস্লাভিয়া বাংলাদেশকে সমর্থন করে। কিন্তু ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে চীন ভেটো দেয়। উল্লেখ্য, চীন তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

১৯৭৩-এর মার্চের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর মন্ত্রণালয় পুনর্বণ্টন করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকে দেওয়া হয় কৃষি মন্ত্রণালয় আর ড. কামাল হোসেন পান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তিনি পেয়েছিলেন একটি যোগ্য-দক্ষ পেশাদার কূটনীতিকদের টিম। নতুন রাষ্ট্রের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি স্থাপনের কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তাঁর সেই টিমের।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্সটার্নাল পাবলিসিটি ডিভিশন এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) যৌথভাবে বাংলাদেশ নিউজ নামের একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বুলেটিন প্রকাশ করত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রচারের জন্য। আমি সেটি বহু বছর সম্পাদনা করেছি। বহিঃপ্রচার বিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন, পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দিন আহমদ, জাতিসংঘ বিভাগের মহাপরিচালক আবুল আহসান, ওই বিভাগের পরিচালক রিয়াজ রহমান জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার ব্যাপারে দক্ষতার সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন, তা প্রত্যক্ষ করেছি।

অনেক দেশকেই জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৭৩-এর শেষ দিক থেকে বঙ্গবন্ধু জোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হয়, তার মধ্যে ছিল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি)। আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যখন যোগ দেন, তখন তিনি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে তাঁদের সমর্থন চান। সৌদি আরব স্বীকৃতি না দিলেও তিনি বৈঠক করেন সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে। ১৯৭৩-এর শেষ এবং ’৭৪-এর শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু কামাল হোসেনকে অনেক দেশে তাঁর দূত হিসেবে পাঠান বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য। ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর করেন আলজেরিয়া, লিবিয়া, কুয়েত, ইরাক, লেবানন, জর্ডান, বৈরুত, কাতার, বাহরাইন, দোহা, আবুধাবি ও সৌদি আরব। তাঁর ওই সফর ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচারণা সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলোর ভুল ধারণা তাতে দূর হয়। এর মধ্যে চীনও তার অবস্থান পরিবর্তন করে। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানি, ’৭৩-এর শেষ এবং ’৭৪-এর প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন–লাইকে ব্যক্তিগত চিঠি দেন।

১৯৭৪-এর প্রথম দিকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঢাকায় নিযুক্ত প্রতিনিধিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আলাদাভাবে ব্রিফ করা হয়। তাঁদের সমর্থন প্রত্যাশা করা হয় এবং তা পাওয়া যায়। ১৯৭৪ সালের ১০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের কাছে সমর্থন চেয়ে চিঠি দেন।

প্রথম পররাষ্ট্রসচিব সৈয়দ আনোয়ারুল করিম (এস এ করিম) ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি। শেষ জীবনে তাঁর ভাই বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও লেখক সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজের ধানমন্ডির অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর সঙ্গে কথা হতো। বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে তিনি বইও লিখেছেন। সে সময়ের নানা বিষয়ে তিনি স্মৃতি রোমন্থন করতেন। সদস্যপদের জন্য সব আয়োজন যখন শেষ পর্যায়ে, তখন বেলগ্রেডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ আর এস দোহা ঢাকায় জরুরি বার্তা পাঠান, যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোর মাধ্যমে চৌ এন–লাই অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ যেন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আর কিছুদিন দেরি করে আবেদন করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কিছু দ্বিপক্ষীয় বিষয় ফয়সালার যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দিন আহমদ তখন ছিলেন নিউইয়র্কে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রাষ্ট্রদূত তাঁকে জানান, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয় বিবেচনা করছে।

১৯৭৪-এর জুনে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। ১০ জুন নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। এবার চীন বিরোধিতা করেনি, তবে ভোটদানে বিরত থাকে। নিরাপত্তা পরিষদ সুপারিশসহ সাধারণ পরিষদে পাঠায়। রীতি অনুযায়ী ১৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হলে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ বিশ্বসভার ১৩৬তম সদস্য নির্বাচিত হয়। ড. কামাল হোসেন মঞ্চে উঠে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তারপর তাঁকে প্রথম অভিনন্দন জানান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাশেই ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং, তাঁর মুখে সন্তুষ্টির মৃদু হাসি। বাংলাদেশের পক্ষে লবি করতে তিনি ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব কেওয়াল সিং ভূমিকা পালন করেন।

২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কে পৌঁছান। ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় তাঁর ভাষণ দেন, যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। তাঁর ওই অভিভাষণ ছিল জাতির জন্য ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শুরু করেন; ‘আজ এই মহান পরিষদে আপনাদের সামনে দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। মানবজাতির এই মহান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রতিনিধিত্ব লাভ করায় আপনাদের মধ্যে যে সন্তোষের ভাব লক্ষ করছি, আমিও তার অংশীদার। বাঙালি জাতির এটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম আজ বিরাট সাফল্যে চিহ্নিত।’

তিনি বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে যুক্ত ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকারের জন্য বাঙালি জাতি বহু শতাব্দী ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। তারা চেয়েছে বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করতে।’

বঙ্গবন্ধু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব বিষয়ই স্পর্শ করেন। তিনি বলেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। ...আমরা শান্তিকামী বলে আমাদের এই উপমহাদেশে আমরা আপস-মীমাংসানীতির অনুসারী। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়েছে এবং অতীতের সংঘাত ও বিরোধের বদলে আমাদের তিনটি দেশের জনগণের মধ্যে কল্যাণকর সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।’

বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন যান এবং প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গেও তাঁর নিউইয়র্কে বৈঠক হয়। কথা প্রসঙ্গে তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বঙ্গোপসাগরে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে।’ কিসিঞ্জার মশকরা করেন, ‘তাহলে তো আমরা বাংলাদেশ থেকে তেল কিনব।’ বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, ‘হতে পারে, নট আনলাইকলি।’ বৈঠকের সময় এস এ করিম উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশে তখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছিল। পেট্রোলিয়াম কেনার টাকা ছিল না। দেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু ইরাকে যান। সেখানে প্রেসিডেন্ট হাসান আন বকর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে বৈঠক এবং কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তাতে ইরাক ন্যূনতম দামে বাংলাদেশকে তেল দেয়। ৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক