একটুকু ছোঁয়া

কথা না বলে মাত্র কয়েক মুহূর্তের স্পর্শে আমরা প্রকাশ করি কত অনুভূতি, না বলা কথা

স্যাম, পুরো নাম স্যামুয়েল জর্জ। আমার বন্ধু, একসময়ের সহকর্মী। শুক্রবার কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করত স্যাম। উদ্দেশ্য তার দাদাকে দেখতে যাওয়া। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে। বছরের পর বছর স্যাম এ কাজটা করে এসেছে। দাদাই একমাত্র কাছের মানুষ। তার কাছে সে বড় হয়েছে। আপনজন বলতে তেমন আর কেউ নেই স্যামের।

একদিন সে বলল, ‘যাবে আমার সাথে?’ এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। বিছানায় শোয়া অশতিপর বৃদ্ধ। হাসিমাখা মুখ। শ্যাম গিয়ে পাশের চেয়ারটিতে বসল। দাদার হাত দুটি ধরে রইল অনেকক্ষণ। কোনো কথা নেই। আমি পাশে দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে পেছনের পাতাহীন বড় গাছগুলো দেখা যাচ্ছে । বিলেতের শীত বড় রুক্ষ। ওর দাদার স্মৃতিভ্রংশ। কথা বলতে না পারলেও স্যামকে চিনতে পারে। আসতে দেরি হলে এদিকে–ওদিকে তাকিয়ে সে খোঁজে স্যামকে।

স্যামের সঙ্গে কথা হলো গত মাসে, অনেক দিন পর। দাদাকে লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন দেখেনি। ও শুধু তো দেখতে যেত না, যেত একটু ছুঁয়ে দিতে। ডিসেম্বর থেকে ছুঁয়ে দেওয়ার লোক আরও একজন কমে গেল স্যামের।


আমাদের নিকট প্রতিবেশী ক্যারোল। পঁচাত্তর বা তার একটু বেশি হবে বয়স। করোনা শুরুর পর, গত বছর অ্যালান মারা গেছে। তারপর থেকে ক্যারোল একা। নিজের কাজ মোটামুটি নিজেই করে। গোছানো ঘর। সাজানো বাগান। ছেলেমেয়েরা থাকে লন্ডনের অন্য প্রান্তে। নিয়ম করে সপ্তাহান্তে এসে মাকে দেখে যায়। কেমন দেখা? দরজার এক প্রান্তে বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক মহিলা দাঁড়িয়ে, ছ মিটার দূরে বাড়ির বাইরে সন্তান দাঁড়িয়ে। কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে এটাও অনিয়মিত হয়ে গেল।

বিলেতে সারা বছরই কমবেশি ঠান্ডা বা বৃষ্টি। আস্তে আস্তে শীত কিছুটা কমতে শুরু করেছে। যখন রোদ থাকে, ক্যারোল ঘর ছেড়ে আসে তার পেছনের বাগানে। রেডিও চলে। রেডিওর আওয়াজ শুনে আমাদের তিন বছরের ছোট মেয়েটিও বাগানে আসে। দুজনের কথা হয়, গল্প হয়। অধিকাংশই ফুল আর পাখি নিয়ে। মাঝখানে কাঠের বেড়া। মাঝে মাঝে মেয়েকে কোলে তুলতে হয়। যাতে দুজনে দুজনের মুখ দেখতে পারে। মুখ দেখা হয়, কিন্তু ছোঁয়া হয় না। গল্প শেষ করে ক্যারোলের আক্ষেপ, ‘ওকে কবে একটু জড়িয়ে ধরতে পারব, ছুঁতে পারব?’
‘আর মাত্র কয়েকটা মাস, ক্যারোল।’
‘তুমি গত বছর থেকে একই কথা বলে আসছ।’
‘আমার আর বলা হয় না উত্তরটা আমিও জানি না।’


স্কুলে বাংলা আর ভূগোল পড়াতেন গুরুপদ নন্দী। অঙ্ক আর বিজ্ঞান লুৎফর রহমান। স্কুল ফাইনালের ফল বের হলো। প্রচণ্ড গরম। ছাত্রের বাড়িতে শিক্ষক। আমি বেরোতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। অন্য ধরনের ছোঁয়া। প্রাপ্তির, অর্জনের আর স্বীকৃতির। দুজনের কেউ বেঁচে নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, একবারের জন্য হলেও তাদের হাতটি যদি ধরতে পারতাম। বলতে পারতাম, অনেক, অনেক ঋণী আমি তোমাদের কাছে।

আনন্দে, বিষাদে, অর্জনে বা শঙ্কায় আমরা একে অপরকে স্পর্শ করি। স্পর্শকে বলা হয় আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্দ্রিয়।

কথা না বলে মাত্র কয়েক মুহূর্তের স্পর্শে আমরা প্রকাশ করি কত অনুভূতি, না বলা কথা। আমাদের মস্তিষ্ক স্পর্শের ধরন বুঝতে পারে। কোনটা আদরের, কোনটা আস্থার, কোনটা পাশে থাকার বা কোনটা বিপদের। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের মতে, সৎ আর অসৎ স্পর্শ শনাক্ত করতে মস্তিষ্কের প্রয়োজন মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত।

ত্বক, স্নায়ু আর মস্তিষ্কের এক দারুণ সমন্বয় হয় যখন আমাদের কেউ স্পর্শ করে। আমেরিকার মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, স্পর্শে আমাদের মস্তিষ্কে একাধিক হরমোনের নিঃসরণ হয়। তৈরি হয় অক্সিটোসিন—ভালোবাসার হরমোন। অন্যের সঙ্গে বন্ধন তৈরিতে অক্সিটোসিনের ভূমিকা রয়েছে। অক্সিটোসিনের কারণে বিপদে বা বৈরী পরিবেশে, আমাদের কোনো প্রিয়জন বা বন্ধু যখন হাতটা ধরে, তখন আমরা নিরাপদ বোধ করি। নিঃসৃত হয় ভেসোপ্রেসিন। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ভেসোপ্রেসিন আমাদের রক্তচাপ কমায়। এই দুই হরমোন আমাদের মানবিক এবং সামাজিক হতে সাহায্য করে।

প্রিয়জন বা বন্ধুর একটুকু ছোঁয়াতে উজ্জীবিত হয় মস্তিষ্কের বিশেষ একটি অংশ—হিপোক্যাম্পাস। মস্তিষ্কের এই অংশটি আমাদের মনে রাখতে সাহায্য করে। সে জন্যই কিছু কিছু ছোঁয়া আমরা দীর্ঘদিন পরও মনে রাখি। কিছু স্পর্শে, আমরা মিটিয়ে ফেলি দীর্ঘদিনের বিরোধ।

শিশুর মানসিক এবং শারীরিক বিকাশে বাবা-মায়ের স্পর্শের ভূমিকা প্রমাণিত। হার্ভার্ডের গবেষক মেরি কারলসন দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে দেখতে পেয়েছেন ছোটবেলায় বাবা-মায়ের স্পর্শ পাওয়া শিশুরা স্পর্শ না পাওয়া বা কম পাওয়া শিশুদের চেয়ে শান্ত মাথায় বিপদ মোকাবিলা করে। ছোটবেলায় নিয়মিত স্নেহের স্পর্শ পাওয়া শিশুদের শরীরে কর্টিসোনের মাত্রা কম থাকে। কর্টিসোনকে বলা হয় স্ট্রেস হরমোন। দেখা গেছে শৈশবে ভালোবাসার স্পর্শ পাওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম।

যন্ত্রের ছোঁয়া কি আমাদের দেহ আর মনে প্রিয় বন্ধুর স্পর্শের মতো একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে? একদমই না। প্রমাণ করেছেন মায়ামির বিজ্ঞানীরা।

ঘরবন্দী মানুষ। এক বছরের ওপরে। শুধু ব্রিটেনেই ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা দেড় কোটির ওপরে। এঁদের অধিকাংশই একা বা সঙ্গিনীর সঙ্গে বাড়িতে বা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। লকডাউনের কারণে প্রিয়জনের উষ্ণ ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত আমরা সবাই। তবে প্রভাবটা শিশুদের আর বয়স্কদের ওপর বেশি। মহামারিতে আমাদের অনেকেই হারিয়েছি স্বজনকে, বন্ধুকে বা সহকর্মীকে। প্রিয় মানুষকে শেষ ছোঁয়াটুকু দেওয়া থেকেও বঞ্চিত হয়েছি অনেকেই। বিশেষ করে যারা দেশান্তরে।

চোখের নিমেষেই আমাদের সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যাসকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। অপেক্ষায় আছি। প্রিয়জন, প্রিয় বন্ধুকে গিয়ে হাতটি ধরার। কিছু হাত আর কোনো দিনই ধরা হবে না।

ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]