এখন সরকারের দায়িত্ব বেশি

অঙ্কন: মাসুক হেলাল
অঙ্কন: মাসুক হেলাল

বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আসার পর অবস্থা বদলে গেল। এখন সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের অবাধে নির্বাচন করার পথে কোনো বাধা নেই। সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকলে এর দায় গিয়ে পড়বে সরকারের ওপর।
কয়েক দিন আগে দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই মুহূর্তে নির্বাচন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি না—এ প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচন তো হারার জন্যও দিতে হয়।’ (প্রথম আলো, ২২ মার্চ, ২০১৫)। এর তাৎপর্য গভীর। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বিষয়টি তাঁদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হলে তিনি এ কথা বলতেন না। আগেও গাজীপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রভাবশালী প্রার্থীদের হারিয়ে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জিতে এসেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার জালিয়াতি করে জেতার চেষ্টা করেনি বা করলেও সফল হয়নি। অবশ্য শেষ মুহূর্তে এসে ঢাকার নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছিল। এখন সেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনে আসার জন্য বিএনপিকে সময় নিতে হয়েছে। কারণ, তাদের প্রায় সব মূল নেতাই জেলে অথবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। শত শত মামলা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ। র্যা ব-পুলিশ নাকি সন্ধান পায় না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এটা যে কী সাংঘাতিক ব্যাপার, তা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। এ অবস্থার মধ্যে বিএনপি কিছুটা ইতস্তত ভাব নিয়ে নির্বাচনে এসেছে।
বিএনপির এই সিদ্ধান্তের প্রতি ইতিবাচক সংকেত দেওয়ার জন্য সরকারের অন্তত কিছু পরিষ্কার ঘোষণা ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। যেমন, মামলা-মোকদ্দমার লাগাম টেনে ধরা, ধরপাকড় বন্ধ প্রভৃতি। কিন্তু সরকার ঠিক উল্টো কাজটি করল। পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়ে দিলেন, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তিনি প্রকাশ্যে আসামাত্র গ্রেপ্তার করা হবে। আরে বাবা! সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেওয়ার চেয়ে বড় কাজ এখন আর কী আছে? গ্রেপ্তারের জন্য তো হাজার সময় পড়ে আছে। আগে নির্বাচন যাক। তারপর কথা।
এত দিন সরকার মাথা ঠুকে মরেছে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য। আর এখন সরকারের পুলিশ গ্রেপ্তারের ভয় দেখাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যদি কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ বলে গ্রহণ করে, তাহলে তাঁর নির্বাচন করার সব সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে কি নেই, সেটা পরের কথা। কমিশন সবকিছু দেখেশুনেই তাঁকে নির্বাচনের অনুমতি দেবে। পুলিশ সেখানে এককভাবে কিছু করতে গেলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা থাকবে না।
এখানে নির্বাচন কমিশনেরও অনেক কিছু করার আছে। পুলিশ কর্মকর্তার কথার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বললেন, ‘... এসব ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার নেই। তবে কারও বিরুদ্ধে মামলা না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ যদি তাঁকে হয়রানি করে, তাহলে কমিশন অবশ্যই ভূমিকা রাখবে।’ (প্রথম আলো, ২৯ মার্চ)। কমিশনার বলছেন ‘করার কিছু নেই’, অথচ হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন যদি তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ না করে, সেই সুযোগে যদি পুলিশ ছড়ি ঘুরিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠছাড়া করে, তাহলে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। সেই দায় গিয়ে পড়বে সরকারের ওপর।
এর আগে শত নাগরিক কমিটি শুধু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা মাত্র দু-তিন দিন পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার একক দায়িত্বে সেই অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে জানিয়ে দিলেন, বিএনপির বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এই মুহূর্তে নির্বাচনে বিএনপিকে যে কত দরকার, সেটা যদি এখনো কমিশন না বোঝে, তাহলে কবে বুঝবে? আরেকবার ‘একতরফা’ নির্বাচনের চুনকালি গায়ে মাখার পর?
সরকার হয়তো বলবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, কাউকে জামিন দেওয়া না-দেওয়া আদালতের এখতিয়ার, সেখানে সরকার কী করবে? ঠিক কথা। কিন্তু সরকার মামলাগুলো তুলে নিলে তো জামিনের প্রশ্ন আর থাকে না। তখন সবাই নির্বাচনের মোহনায় মহাসমারোহে মিলিত হবে।
নির্বাচনে বিএনপির দিক থেকে একটু ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। প্রথমে উৎসাহ ছিল। শত নাগরিক কমিটি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের অচলায়তন ভাঙে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বারবার বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁদের দলের সমর্থন রয়েছে। গত রোববার বিএনপি হরতালের ডাকও দিল না। প্রায় আড়াই মাসের একটা প্রথা ভেঙে তারা ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এগিয়ে আসার লক্ষণ না দেখে এবং গ্রেপ্তারের কথা শুনে হয়তো থমকে দাঁড়াল। মনোনয়নপত্র জমার তারিখও পেছানো হলো না। হয়তো এসব কারণে বিএনপি এক দিন পর আবার হরতাল ডেকে বসল। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদ রেখে আবার যথারীতি হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করল। বিএনপি এক কদম এগিয়ে এসে এভাবে আবার পিছিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দিল, তারা আস্থা পাচ্ছে না। সরকারকে এখন এগিয়ে এসে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রথম কাজটি হবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মুক্তি দেওয়া। এর সঙ্গে প্রথম সারির বাকি নেতাদেরও একে একে কারামুক্ত করা। বিএনপির উদ্যোগে বড় বড় সমাবেশ হোক। সেখানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হয়ে আসুন। তিনি তো এখন সাংসদও নন, তাই তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বাধা নেই। এই সুযোগটি বিএনপিকে দিতে হবে। না হলে কিসের মেয়র নির্বাচন? নির্বাচনী আমেজই তো আসবে না।
আর এসব সুযোগ যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে বিএনপিকেও ভেবে দেখতে হবে যে অচল অবরোধ-হরতাল তারা আর কত দিন চালাবে। আর কত অর্থহীন হরতাল করলে তাদের আন্দোলন একটি ‘যৌক্তিক পরিণতি’ পাবে।
কৌশলগত কারণে হলেও এখন তাদের সহিংস কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে। না হলে হয়তো বিএনপিকে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। হরতাল-অবরোধ থাকলে এখানে-সেখানে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ হয়তো ঘটতেই থাকবে। বিএনপি নিজেরা হরতাল ডেকে কীভাবে নাশকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? এ পরিস্থিতিতে তাদের সমর্থিত প্রার্থীরা কোন মুখে ভোট চাইবেন? একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে মানুষ পুড়িয়ে মারা কোনো কাজের কথা নয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকার, বিএনপি ও দেশের মানুষ—সবার জন্যই খুব দরকার। বিএনপিকে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলে সরকার অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে। যদি বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা জেতেন, তাহলেও লাভ। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, সেটা জোর গলায় তারা বলতে পারবে।
১৯৯১ সালে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করার পর ১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফ মেয়র হয়েছিলেন। তাতে তো বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়নি। গত বছর যে কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা একের পর এক মেয়র নির্বাচিত হলেন, তাতে কি আওয়ামী লীগ সরকারের গদিতে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেছে? তাহলে?
নির্বাচনে বিএনপির লাভও কম নয়। তাদের সমর্থিত প্রার্থী যদি জেতেন, তাহলে তো পোয়াবারো। সামনের দিনগুলোতে দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আরও জোরদার হবে। আর যদি না-ও জেতেন, তাহলেও বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসার চমৎকার সুযোগ পাবে। তাদের আন্দোলন একটি ‘যৌক্তিক’ পরিণতি পাবে।
আর মানুষও সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরে পাবে, পেট্রলবোমায় অপমৃত্যুর ভয় কাটবে।
আমরা তাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, একটি ভালো নির্বাচন হোক। বিএনপি সুস্থধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়ে বড় কিছু এই মুহূর্তে আর হতে পারে না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]