এখনো ট্রাম্পকে ভালোবাসেন যাঁরা

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে যে ৭ কোটি ৪০ লাখ ভোটার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে তাঁর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের বাইরে কি আর কেউ আছেন, যাঁরা তাঁকে এখনো সমর্থন করছেন? এই প্রশ্ন অনেকেরই।

ট্রাম্পের হেরে যাওয়াকে বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান উদ্‌যাপন করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প এখনো চরম ডানপন্থী অনেক নেতা এবং জনতুষ্টিবাদী বহু লোকের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে টিকে আছেন। চার বছর ধরে তিনি স্বৈরশাসকদের প্রশংসা করেছেন এবং অসহায় অভিবাসী, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং মুসলমানদের (গুটি কয়েক সৌদি রাজপুত্র ছাড়া) প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে উপহাস করে তিনি হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ব্রাজিল, ভারত ও ফিলিপাইনের বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে সমর্থন দিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি তাঁর প্রশংসাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কারও কোনো সন্দেহই নেই। এসব কারণে দেশের বাইরেও ট্রাম্পের অনেক সমর্থক আছেন বলে মনে করা যেতে পারে।

ট্রাম্পের ভরাডুবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতায় থাকা জনতুষ্টিবাদীদের জন্য একটি বড় পশ্চাদপসরণ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও ট্রাম্প দক্ষিণপন্থীদের শিবিরে যে উদ্দীপনার ঝড় বইয়ে দিয়ে গেছেন, তা সহসাই থেমে যাবে বলে মনে হয় না।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই যে ট্রাম্পের বহু কট্টর সমর্থক আছেন তা নয়। ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রাম্প অনেক গণতান্ত্রিক দেশের জনগণেরও সমর্থন পেয়েছেন। যেমন ইসরায়েল এবং তাইওয়ানের জনগণের তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন। ইসরায়েলের নাগরিকেরা মনে করে তাদের প্রধান শত্রু ইরানের ঘোর শত্রু হলেন ট্রাম্প। এ ছাড়া ট্রাম্প যেহেতু চীনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে কারণে তাইওয়ানের জনগণ তাদের অধিকার খর্ব করা চীনের বিরোধিতাকারীকে বন্ধু হিসেবে দেখেছেন।

ইসরায়েলের ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে যা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিন কিছুই পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইসরায়েলের উন্মত্ত সমর্থকেরা ট্রাম্পের একনিষ্ঠ সমর্থক। এঁদের বেশির ভাগই আমেরিকান ইহুদি নয়, কিন্তু ইভেনজেলিক্যাল খ্রিষ্টান (যাঁরা বিশ্বাস করেন, যিশুর দ্বিতীয়বার আগমনের আগে পর্যন্ত পবিত্র ভূমি রক্ষার ভার ঈশ্বর তাঁর মনোনীত ব্যক্তিকে দেন। যিশুর দ্বিতীয় আগমনের পর সব ইহুদিকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হতে হবে)। এই ইভেনজেলিক্যাল সম্প্রদায় প্রথম থেকেই ট্রাম্পকে ঈশ্বরের ‘মনোনীত পুরুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। ট্রাম্প পরাজিত হলেও তাঁদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁরা আবারও ট্রাম্পকে নির্বাচিত করার বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

এ বছরের গোড়ায় আমি হংকং ও তাইওয়ানের গণতন্ত্রপন্থী অধিকারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তাঁরা ট্রাম্পকে একজন গোঁয়ার লোক বলে ভাবেন; একই সঙ্গে তাঁরা এটিও মনে করেন, সমাজতান্ত্রিক উৎপীড়ন থেকে তাঁদের যদি কেউ মুক্তি দিতে পারেন, তিনি হলেন ট্রাম্প।

তবে পূর্ব এশিয়ায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার একটি মজার দিক হলো, এখানকার বহু ট্রাম্প সমর্থক ডানপন্থীও নন, আবার ডান বিরোধীও নন। এটা ঠিক যে চীনের কিছু লোক ট্রাম্পের মুসলমানবিরোধিতার কারণে তাঁকে পছন্দ করেন। কিন্তু সেখানে ট্রাম্পপন্থী চেতনা বিস্তারের এটিই একমাত্র কারণ নয়।

এ বছরের গোড়ায় আমি হংকং ও তাইওয়ানের গণতন্ত্রপন্থী অধিকারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তাঁরা ট্রাম্পকে একজন গোঁয়ার লোক বলে ভাবেন; একই সঙ্গে তাঁরা এটিও মনে করেন, সমাজতান্ত্রিক উৎপীড়ন থেকে তাঁদের যদি কেউ মুক্তি দিতে পারেন, তিনি হলেন ট্রাম্প।

হংকংয়ে বিক্ষোভের সময় বিক্ষোভকারীদের বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা বহন করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে তাইওয়ানে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টিকে নির্বাচনী মিছিলে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। এখানেও খ্রিষ্টান মূল্যবোধ দারুণভাবে কাজ করেছে। হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী নেতা জিমি লাই একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান এবং তিনি মনে করেন, চীনের কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে হংকংয়ের আন্দোলনকারীদের সংঘাতের মূলে আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। তাঁরা মনে করেন, চীন সরকার হংকংবাসীকে অন্য সব ধরনের পীড়নের পাশাপাশি তাঁদের ধর্মচর্চায় বাধা দিয়ে থাকে।

তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ধর্মীয় কারণে নয় বরং উদার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের অবস্থান থাকার কারণে হংকং, তাইওয়ান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি খোদ চীনেও বহু মানুষ ট্রাম্পকে সমর্থন করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, ট্রাম্প চীনকে চাপে রাখার ক্ষমতা রাখতেন।

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে অনেক ট্রাম্প সমর্থক আছেন। তাইওয়ানে যেমন বেশির ভাগ লোক ট্রাম্পকে সমর্থন করেন, এ দুই দেশে তাঁদের সংখ্যা তত নয়।

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীন ইস্যুতে ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে আসবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন চীনের সঙ্গে বাগাড়ম্বরে না গিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করবেন। কিন্তু চীন যদি অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকে যেতেই থাকে, তাহলে এ দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক থাকবেই, এমনকি সে সম্পর্ক এখনকার চেয়ে আরও খারাপও হতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ইয়ান বুরুমা: ডাচ বংশোদ্ভূত লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক