‘এট্টা মুখ তো, কতা কম কবা’

বোবার শত্রু নাই—এ কথা বোবারা ছাড়া সবাই জানে। হার আদমি জানে, কথায় কথা বাড়ে। যার কথা যত বাড়ে, তার শত্রুও তত বাড়ে। তারপরও লোকে খালি কথা বলে। জায়গায় বলে, অ–জায়গায় বলে। প্রকাশ্যে বলে। গোপনে বলে। কেউ ক্যামেরার সামনে বলে ধরা খায়, কেউ লুকোনো ক্যামেরায় ধরা পড়া কথার প্যাঁচে আটকে দাঁত কেঁটকি মারে। মায়ের পেট থেকে পড়ার পর সেই যে মুখ ছোটে, গোরে যাওয়ার আগে সে চোপা আর থামে না। কারণ, নীরবতা আমজনতার ধর্ম না।

স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে আসা অভিমানী মেয়েকে বাপ ফিরে যাওয়ার জন্য ‘সোনা রে, মনা রে, জাদু রে’ বলে বোঝাতে থাকে। সেই একই কায়দায় সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের ময়মুরব্বি একজোট হয়ে পাবলিককে বোঝাতে থাকে—সব জায়গায় ‘সব কথা কহতব্য নয়’; মুখে কুলুপ মারাও একটি মারাত্মক জাতীয় জনগুরুত্বসম্পন্ন কাজ। সীতানাথ বসাক প্রণীত বাল্যশিক্ষাধর্মী এই পাঠ আবালবৃদ্ধবনিতা ভালো কথায় বুঝলে ভালো, নইলে দাবড়ানি। তারপরও না বুঝলে মস্তিষ্কপ্রক্ষালক যন্ত্রে ঢুকিয়ে ‘শাটআপ’ থেরাপি। কী আর করা! যে রোগের যে ওষুধ!

কিন্তু পাবলিক বড় ঠ্যাটা ‘জাতি’। এই জাতি দুই বেলা না খেয়ে দাঁত কিড়িমিড়ি দিয়ে থাকতে পারবে, কিন্তু কথা না বলে থাকতে পারবে না। ‘সব কথা সব সময় বলতে নেই’—এই অমিয় বচন পাখিপড়া করানোর পরও পেটের কথা মুখ দিয়ে ডেলিভারি দিতে না পারার কষ্ট তাদের কাছে লেবার পেইনের চেয়ে বেশি। তারা যখন ‘কহতব্য’ কথা ‘চিল্লায়া কইতে’ পারে না, তখন তারা ফেসবুকে ‘ফিসফাস’ করে। সেই ফিসফিসানি যদি ‘ডাইরেক্ট’ হয়, তাহলে তার জন্য আছে ডিজিটাল আইনের থাবড়ানি। থাবড়ানি থেকে বাঁচতে তারা তখন লাঠি না ভেঙে সাপ মারার তরিকা হিসেবে সাংকেতিক ভঙ্গিতে ঠারেঠোরে ফিসফাস করে। ‘কলকাতা’ বোঝানোর জন্য ‘ক’ উচ্চারণ করে ব্র্যাকেটবন্দী ফুটনোটে লিখে দেয়, ‘বুঝলে বুঝ পাতা, না বুঝলে তেজপাতা’। এই হেঁয়ালিপূর্ণ ছক্কা–পাঞ্জা কথার মধ্যে অদৃশ্য কথা থাকে। যেন ভাসমান কবিতার নিচে আরেকটি মগ্ন কবিতা। একটি আরেকটির সঙ্গে লগ্ন, কিন্তু নিমজ্জিত; অতএব অদৃশ্য।

একটি যে আরেকটি থেকে পৃথক, তা নয় বরং পরিপূরক। ডুবুরির মতো দৃশ্যমান কথায় ডুব দিয়ে দ্বিতীয় কথাটিকে ধরা যায়। মুদ্রিত বা উচ্চারিত কথার আড়ালে এই যে আরেকটি কথা, যেটি লেখকের বা বক্তার মগ্নকথা, সেটিই কিন্তু আসল কথা।

যখন কোনো সমাজ কিংবা সরকার পাবলিকের শ্রাব্য ‘চিল্লাচিল্লি’ অ্যালাউ করে না; যখন প্রবল উত্তেজনাকর কোনো ঘটনা ঘটার পরও মূলধারার সংবাদমাধ্যম অতি আয়েশি ভঙ্গিমায় ‘চালকুমড়ো চাষ করে টিনের চাল তুললেন কাউয়ার চরের ডলি বেগম’ শীর্ষক খবরকে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার করে, তখন ‘পরসমাচার’ হিসেবে সেই সমাজে ফিসফিসানি বাড়ে। ফিসফিসানির সঙ্গে যুক্ত হয় হেঁয়ালিপূর্ণ ছক্কা–পাঞ্জা ভাষা। নিজের বাবাকে ‘বাবা’ না বলে বলা হয় ‘ফুফাজানের শালা’। কার্টুনিস্ট যেভাবে কার্টুন এঁকে বিদ্রূপাত্মক ইঙ্গিতে কথা বলে, সেভাবে ফেসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ওঠে এমন এক ম্যাগাজিন, যেখানে পাবলিক হয়ে ওঠে একেকজন ‘কথার কার্টুনিস্ট’। এরা সাধারণত ‘চুটকি’ কিংবা ‘কৌতুক’ তৈরি করে। সেই চুটকির ফোকর গলে আসল কথার ‘নকল’ বা কপি বের হয়। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সরকার যত বেশি দাবড়ানি দেয়, চুটকির প্রোডাকশন তত বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একসময় গোটা জাতি এক্সপোর্ট কোয়ালিটিসম্পন্ন চুটকিবাজ হয়ে ওঠে।

স্তালিনের সোভিয়েত মুলুক এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। স্তালিন নাকি সেলফ সেন্সরশিপ বা স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধের চিন্তা রুশদের মাথায় এমন কায়দায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে কতটুকু শব্দ করে বাতকর্ম সারলে সরকার রাগ করতে পারে, সেদিকেও তারা নাকি খেয়াল রাখত। সরাসরি বক্তব্য প্রকাশ করতে না পারায় সেখানকার লোকের মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ চুটকি বলার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। উচ্চফলনশীল স্যাটায়ার বা বিদ্রূপাত্মক রূপক গল্পের আবাদক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল রুশ সাহিত্য। আজকের পুতিনের রাশিয়াও সেলফ সেন্সরশিপের ধারণা অব্যাহত রেখে সেই সাহিত্যক্ষেত্রকে হেকমতের সঙ্গে ঋদ্ধ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে মিসর, তুরস্ক, ইরানেও চুটকির চাষ ভালোই হচ্ছে।

পাকিস্তানে এখন এই জিনিসের বাম্পার ফলন হয়েছে। সেখানে ‘ইলেকট্রনিক আইন’ নামের একটি আইন আছে, যা দিয়ে ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের চৌদ্দগুষ্টিকে চৌদ্দ শিকের মধ্যে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা আছে। সেখানকার পাবলিক ফেসবুকে ‘জোক’ প্র্যাকটিস করতে করতে ‘জোকার’ হয়ে যাচ্ছে। তবে সি চিন পিংয়ের চীনে ‘সব কথা’ বলা তো দূরের কথা, ঠাট্টা–মশকরার চুটকিও নিষিদ্ধ। আর মিয়ানমারে সদ্য ক্ষমতা নেওয়া সেনা সরকার মিছিল-মিটিংয়ের পাশাপাশি ফেসবুকই বন্ধ করে দিয়েছে।

ভারতের অধিকাংশ মিডিয়া আউটলেটকে মোদি সরকার মোটামুটি পোষ মানিয়ে ফেলেছে। সেখানে মূলধারার মিডিয়াকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি মাউথপিস হতে দেখে পাবলিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ঢুঁ মারছে। ফেসবুক–টুইটারে ‘হাবিজাবি’ মন্তব্য করায় সেখানেও এখন ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

আমাদের সরকার সব সময় বলছে, এখানে গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। এখানে অনেকগুলো সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে। সরকারের পাশাপাশি এসব সংবাদ প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্তাব্যক্তি বলে থাকেন, সংবাদ প্রকাশে সরকারের দিক থেকে তাঁদের কখনো কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হয় না। সরকারের সঙ্গে তাঁরাও বলেন, এখানে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ আছে। কিন্তু খবর প্রকাশ অথবা সম্প্রচারের ভাবভঙ্গি দেখে যে কারও মনে হতে পারে, মিডিয়া আউটলেটগুলো উগান্ডার কুখ্যাত নেতা ইদি আমিনের সেই কুখ্যাত কথাটিকেই সরকারের কথা হিসেবে ধরে নিয়েছে। ইদি আমিনের কথাটি ছিল, ‘দেয়ার ইজ ফ্রিডম অব স্পিচ বাট আই ক্যান নট গ্যারান্টি ফ্রিডম আফটার স্পিচ (কথা বলার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু কথা বলার পর স্বাধীনতা থাকবে কি না সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি না)।’ ইদি আমিনের কথাকে মিডিয়া আউটলেটগুলো সরকারের কথা বলে ধরে নিয়েছে বলে পাবলিক মনে করছে।

ফেসবুকে লেখালেখির জন্য ইতিমধ্যেই বহু লোক মামলা এবং হাজতের ভাত দুটোই খেয়েছে। এ কারণে ফেসবুকে রূপকধর্মী সৃজনশীল চুটকি আর স্যাটায়ারের উৎপাদন বেড়েছে। এর বাইরে এক পদের লোক আছে, যারা লোকগীতি কবি গুরুপদ গুপ্তর মিতবাক দর্শনের অনুসারী। এই দর্শনের মূল কথা হলো দেশে যত বড় ঘটনা ঘটুক, ‘ও মানুষ, দুডো চোক আর দুডো কান; দ্যাকপা আর শোনবা, কিন্তু এট্টা মুখ তো, কতা কম কবা।’

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

[email protected]