এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল না

নাহ্‌, আমি মানতে পারছি না। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া তো বজ্রপাতের মতো। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক—গোটা বাংলার মাঠে-ঘাটে, জোছনা রাতে, উজ্জ্বল সকাল বা পড়ন্ত বিকেলে তাঁর চৈতন্যে শুধুই ছিল সোনার বাংলার ছবি। তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য সুন্দর সমৃদ্ধির দিন। বাংলাদেশকে নিয়েই ছিল তাঁর সুন্দরের স্বপ্ন। বাংলা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর কাব্যে, নাটকে, কবিতায় পাঠক আলোকিত হওয়ার মতো শব্দচয়নে। পাঠকের বোধের ভেতর জাগত সত্য, সুন্দরের দিকে পরশপাথর খুঁজে নেওয়ার তীব্র নেশা। অসত্যকে উপড়ে ফেলে মানবিক মূল্যবোধে দেশের সুসন্তান হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বোধের ভেতর জাগত নতুন স্পৃহা! তাঁর এ চলে যাওয়া জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি। তবে এ ক্ষতি পুষিয়ে নেবে জাতি তাঁর সাহিত্যের অমৃতধারায়। সৈয়দ হকের সঙ্গে প্রথম আমার দেখা ১৯৭২-এ, যখন জহির রায়হান রাজাকারের আখড়া খুঁজে বের করার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন। জহিরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, এহ্‌তেশাম হায়দার চৌধুরী, হাসান ইমাম, গাজী শাহাবুদ্দিন, আলমগীর কবির, শাহরিয়ার কবির। জহির রাতে ফিরে বারান্দায় বসে আমার পাশে আমার হাতখানা নিজের হাতে তুলে বলত, ‘ভাবি, অপরাধীদের আমরা খুঁজে বের করবই। বড়দা আমাদের মাঝেই অচেনা। এত ভেঙে পড়লে চলবে না আপনাকে। আমি চাই, আপনি বড়দার উপযুক্ত স্ত্রী। মনে সাহস সঞ্চয় করে আমাদের সঙ্গে কাছে আসুন।’ জহির আমাকে জোর করে নিয়ে যেত। তখন মাঝেমধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে দেখা হতো। কী সুন্দর তাঁর কথা বলা। কথাগুলোই যেন কাব্য হয়ে উঠত। বলতেন আমাকে, ‘আপনি যে ঘর থেকে বেরিয়েছেন, আমি খুব খুশি হয়েছি।’

তারপর তো ৩০ জানুয়ারি। জহির হারিয়ে যায়। আমি বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। আবার নিজে নিজে ভাবলাম, নাহ্‌ নাহ্‌, ঘরে বসে থাকব না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

একদিন বাংলা একাডেমিতে হক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ডিজির রুমে বসলাম। আমাকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। তিনি আমাকে অপত্যস্নেহে অনেক দামি উপদেশ দিলেন। এ উপদেশ আমার অনেক উপকারে এসেছে। এই যে মানুষকে আলোর পথ দেখিয়ে সাহসী করে তুলেছেন—আমি যেমন সাক্ষী। অসংখ্য মানুষকে তিনি সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর কাজই মানুষ ও দেশ। এ শিক্ষাটিই তাঁর কাছে পাই।

যখন বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম। কোথায় পোস্টিং হবে কে জানে। আমি বাংলা একাডেমিতে ওহাব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলাম, হক ভাইকে যেন খবরটা দেন। কয়েক দিন পরে ওহাব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। ওহাব ভাই বললেন, হক ভাই বলেছেন, ‘ওকে বলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।’ একই কথা জহুর হোসেন চৌধুরীও বলেছিলেন। ইতিমধ্যে আমি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে জড়িয়ে গেছি। এতে আমার নিরাপত্তার কথাটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। যেহেতু একজন সাহিত্যিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, লেখকদের উপদেশ আমার বোধের ভেতর দারুণ শক্তি দিত। যেমন শক্তি পেতাম নির্মলেন্দু গ‌ুণ, মহাদেব সাহা, কবি শামসুর রাহমান ও অনেকের। নিজের কথা বলতে কলম ধরিনি।

হক ভাইয়ের সঙ্গে এখানে-সেখানে দেখা হলেই অপত্যস্নেহে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলতেন, ‘যত খরস্রোতা নদীই হোক, পাড়ি দিয়ে তীরে উঠবে।’

১৯৯৬-তে যখন সংরক্ষিত আসনে সাংসদ নির্বাচিত হলাম। মনে দ্বিধা ছিল, আমি কি পারব? প্রথম দিন সংসদ অধিবেশনে যখন স্বপ্নের সংসদে বসলাম, গ্যালারিতে বসেন অনেকে এবং বাংলার লেখক-সাহিত্যিক ও প্রথিতযশা ব্যক্তিরা। শমী বসেছিল হক ভাইয়ের পাশে। হক ভাই শমীকে বললেন, ‘তোমার মায়ের জন্য গর্ব হচ্ছে। তোমার মাকে বোলো, আমার দোয়া রইল তার জন্য। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোমার মা যেমন সহজ-সরল, সাবধানে চলতে বলবে।’ শমী বাড়ি ফিরে যখন কথাগুলো আমাকে বলল, আমি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। সভা-সমিতিতে হক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই অপত্যস্নেহে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন।

সংবাদ-এর বজলুর রহমান ভাইয়ের মৃত্যু হলে তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য খেলাঘরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বজলুর রহমান পদক চালু করার পর হক ভাইকে বজলুর রহমান পদকে ভূষিত করে খেলাঘর সম্মানিত হয়েছে।

হক ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ টিভি টক শো চিরকাল স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। সঙ্গে ছিলেন হাসান ইমাম। ৭১ চ্যানেলের এ টক শোতে আমি কি ভেবেছিলাম তাঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না!

হক ভাই আছেন আমাদের সঙ্গে। তাঁর সাহিত্য, নাটক, কবিতা নতুন প্রজন্মকে সত্যের পথ দেখাবে। জাতি তাঁকে স্মরণ করে যাবে চিরায়ত কাল ধরে। তিনি বাংলার জাগ্রত পুরুষ।

‘আজ এখানেই শেষ, আবার কখনো যদি ফিরে আসে বা কোনো দিন অজয় নদীর তীরে-ছাতিমতলার নিচে, উৎসবে নাচবে পলাশ শিমুল।’

পান্না কায়সার: লেখক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ