এতিম ও পথশিশুদের ভুবন: বাবা আমারে চায় না

মাসুদ রানা (৯) টেকনাফের সীমান্ত জেটিতে ভ্যানের ওপর চায়ের দোকান ছিল। এখন বন্ধ।
ছবি: লেখক

পথশিশু মারুফের কথা থেকে গত সপ্তাহে লকডাউন নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। লকডাউন নিয়ে তার কথাগুলো এখানে প্রসঙ্গ নয়। মারুফ আরেকটি কথা বলেছিল, যা প্রায় কেউই খেয়াল করেনি। অন্য একটি ভিডিওতে কথা প্রসঙ্গে মারুফ বলেছিল, তার মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে, আর বাবা তাকে চায় না।

শুনে চমকে উঠেছিলাম। এই কথা তো আমি অনেকবার শুনেছি। প্রথম প্রথম খেয়াল করিনি। কিন্তু একের পর এক শিশু দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাকে বলে গেছে, ‘বাবা আমারে চায় না।’
‘বাবা চায় না’ মানে কী? উৎসাহী হয়ে উঠলাম।

মার্চের ৯ তারিখ। দাকোপের ঐতিহাসিক তিলডাঙ্গার মেলা থেকে বেরোতে বেরোতে রাত নয়টা। যেতে হবে বহুদূরের খুলনা শহর। মানুষের ঢলে যানবাহন পাওয়ার উপায় নেই। এর মধ্যে হাফ প্যান্ট পরা এক কিশোরের ভ্যান খালি পাওয়া গেল। তার চোখে পানি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম তার নাম ওহিদুল। মা-বাবা দুজনেই আলাদা আলাদা বিয়ে করে চলে গেছেন।

তার ভাষায়, ‘আমারে নেয় না। সবাই তো স্কুলে যায়, আমার কেন এমন হলো?’ ওহিদুল সাত বছর বয়সে ইটভাটায় কাজ করা শুরু করে। এখন ভ্যান চালায়, বাড়িতে তার অপেক্ষায় তালাকপ্রাপ্ত এক বোন।

সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের বালুকাবেলায় বসে ছিল ১০ বছর বয়সী নুর মোহাম্মদ। এতিমখানায় থাকে, মাদ্রাসায় পড়ে। বাকি সময় পর্যটকদের ফাইফরমাশ খাটে। তারও বাবা মারা গেছে ছোট থাকতে। সাগরে মাছ ধরত, আর ফেরেনি। সেন্ট মার্টিনে জাহাজ থেকে নামামাত্রই কুলির কাজের জন্য যে বালকেরা জড়ো হয়, তারাও বলবে একই করুণ কাহিনি। যেমন রায়হান, ওর বাবা ওকে চায় না। কেন চায় না? ‘বাবা আরেক মেয়েকে বিয়ে করে চট্টগ্রাম চলে গেছে, তাই আমারে চায় না।’

কক্সবাজার সৈকতে ঝিনুকের মালা বিক্রি করে আবদুল মোতালেব (১০)। মা মালা গেঁথে দেন, সে সারা দিন সৈকতে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। দিনে দু–তিনটা মালা বিক্রি হয়। একেকটায় লাভ হয় ৫০ টাকা। সৈকত থেকে দূরে দরিয়ানগর গ্রামে তার বাড়ি। তারও বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে গেছেন। দিনে যা আয় হয়, তা দিয়ে চাল–আলু কিনে নিয়ে বাড়িতে যায়। মা–ছেলেতে খায়।

অনেকে বলে, এসব ওদের পয়সা কামানোর ধান্ধা। কিন্তু এই ঢাকার বস্তিতে যান, করোনাকালে অভাবের জ্বালায় ঘরছাড়া পুরুষদের খোঁজ নেন, দেখবেন দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারিতে সম্পর্ক কতটা তরল হয়ে যাচ্ছে। পুরুষ স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। একাকী মায়ের হয়তো অন্য পুরুষ জীবিকাসঙ্গী জুটেছে, তাই সন্তানকে নানি-খালার কাছে গছিয়ে তার সঙ্গে চলে যাচ্ছেন। ঘরছাড়া এসব পুরুষের অনেকেই নতুন কর্মস্থলের কাছেই বিয়ে করেন। ফেলে আসা স্ত্রী-সন্তানের খবর তখন অনেকেই রাখেন না। তাঁদের ছেলেরা তখন বলে, ‘আমার আব্বু আমারে চায় না।’

সব গল্পের কমন কথা ছিল, ‘বাবা আমারে চায় না।’ এই লকডাউনের সময়েও বরিশালের এক কিশোরের ভিডিও দেখা হলো। অন্য সময় সে লঞ্চে পানির বোতল, চকলেট এসব বিক্রি করে চলত। লকডাউনে সেই পথও বন্ধ। এখন তারা লুকিয়ে কীর্তনখোলায় মাছ ধরে। বেশির ভাগই বাইলা মাছ। সেই মাছ এক হোটেলে দেয়, বিনিময়ে এক প্লেট খিচুড়ি পায়। সেটাই দিন–রাতের একমাত্র খাবার। সেই ছেলেও বলেছিল, বাবা মারা গেছে, মা কোথায় চলে গেছে, সে জানে না।

টেকনাফের সীমান্ত জেটিতে এভাবে পেয়েছি বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট দোকানি মাসুদ রানাকে (৯)। সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের বালুকাবেলায় দেখেছি ১০ বছর বয়সী নুর মোহাম্মদকে। কক্সবাজার সৈকতে ঝিনুকের মালা বিক্রি করা আবদুল মোতালেবের (১০) চোখের পানি আর সমুদ্রের নোনাপানি এক হওয়া দেখেছি। ভোলার চরফ্যাশনে দেখেছি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ফিরে না আসা জেলেদের শিশুদের। দল বেঁধে তারা মেঘনার পাড়ে জোয়ারে-আসা জিনিস টোকাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের মায়েদের আবার বিয়ে হয়, না হয়ে উপায় থাকে না। মায়ের দ্বিতীয় সংসারে তাদের জায়গা হয় না। ঢাকায় হলে তারা হয়ে পড়ে মারুফের মতো পথশিশু, আর নদী বা সমুদ্রবন্দরে, সৈকতে তারা হয় মালবাহী কুলি বা টুকিটাকি ফরমাশ খাটা চাকর কিংবা ঝিুনকের মালা বিক্রেতা।

এই করোনায় যখন বন্দর-ঘাট-পরিবহন সব অচল, তখন কীভাবে ওরা টিকে আছে? এদেরই একজন মাসুদ রানা। মাত্র ৯ বছর বয়সে সে ভাগ্যবদলের যাত্রা শুরু করেছিল। করোনা এসে তাকে থামিয়ে দিল।

তখন অনেক ভোর। পর্যটকভরা বাসগুলো একে একে এসে থামছে টেকনাফে। শিশু-কিশোরেরা ঘিরে ধরছে পর্যটকদের। ওদিকে নাফ নদীর সীমান্ত জেটির দিকে এগিয়ে চলছে একটি ভ্যানগাড়ি। দূর থেকে চালককে দেখা যায় না। নৌ সীমান্তচৌকিতে বিজিবির প্রহরী বদলের আগেই কাজ শুরু করে মাসুদ রানা। তাদের গাছপালা ঘেরা ঝুপড়ি ঘরের সামনে তালা দিয়ে রাখা ভ্যানগাড়িটা ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে। তারপর কয়েক রকম সস্তা চকলেটের কয়েকটা বয়াম, চানাচুর, চিপস, বিস্কুটের প্যাকেটগুলো সাজিয়ে রাখতে হবে। এসব করতে করতে তার মা চায়ে ভরা বড় একটা লাল ফ্লাস্ক আর ধোয়া কাপ এনে রাখবে ভ্যানগাড়িটার ওপর।

ভ্যানগাড়িটা ঠেলতে ঠেলতে দিন শুরু হবে রানার। ঠেলতে ঠেলতে চলে যাবে সমুদ্রের দিকে। এখানেই বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত শেষ। মূল ভূমি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার সেতু চলে গেছে বাদাবনের ওপর দিয়ে সমুদ্রের ভেতরে। এই সেতুর গোড়ায় বড় বাঁধানো চত্বর। সেখানেই ভ্যানগাড়ির ওপর ৯ বছর বয়সী মাসুদ রানার দোকান।
রোদে পোড়া শীতে কুঁচকানো মুখ ছেলেটার। রাতের ডিউটি শেষ করা বিজিবি সদস্যরাও অবাক, ‘কী রে এই দোকান তোর?’

ছেলেটা মৃদু স্বরে বলে, ‘হ্যাঁ, আমার আম্মু করে দিয়েছে।’

এ রকম অজস্র বালকের দেখা যায় টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপগামী জাহাজঘাটায়, সৈকতে, ছেঁড়াদ্বীপে কিংবা কক্সবাজারের সৈকতে।

‘আঙ্কেল ব্যাগটা উঠাই দিই?’
‘আন্টি ঝিনুকের মালা নিবেন?’
‘ভাইয়া, মাথা বানায়া দিব?’

এসবে কাজ না হলে বলবে, ‘ফুটবল খেলাইবেন? ফুটবল ভাড়া দিই, টিউব ভাড়া দিই। ঘণ্টায় ২০ টাকা।’

তাদের কোমল হাত আর ছলছল চোখকে না করা কঠিন। তাদের বেশির ভাগের গল্প একই রকম। মাসুদ রানার ছোট ভাইটা যখন মায়ের পেটে তিন মাস, তখন সমুদ্রের ঝড়ে তার বাবার নৌকা ডুবে যায়। তিন দিন পর চার জেলের লাশ আসে টেকনাফ থানায়। তাদের একজন মাসুদের বাবা। সেই ছোট ভাইটার বয়স এখন ২ বছর ৪ মাস। করোনার আগে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত মাসুদ রানা।
‘স্কুল বন্ধ তো, তাই দোকান করি।’
তো বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট দোকানদারের দৈনিক বিক্রি কত?
‘১ হাজার হয়, ৫০০ টাকা হয়।’
‘লাভ কত থাকে?’
‘হাজারে দুই শ/আড়াই, পাঁচ শতে দেড় শ’।

টেকনাফের জেটিঘাটে যাওয়ার পথে পড়ে চৌধুরীপাড়া। সেখানে মাসুদ রানাদের ছোট্ট এক ঘরের বাড়ি। মা মাটি কাটার কাজ করেন, ছেলে করে দোকানদারি। মায়ের কথা, ‘এখন তো বাবু দোকান নিয়ে যায়; স্কুল খুললে মাটি কাটা শেষে আমি দোকান চালাব। আমার বাবুর পড়ালেখার মাথা ভালো।’

এই ৩০ এপ্রিল দুপুরে কথা হলো মাসুদ রানার মায়ের সঙ্গে। লকডাউন ও রোজায় মাসুদ রানার ভ্যানগাড়ির দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে। মায়ের মাটি কাটার কাজটাও আর নেই। তাঁরা এখন এর–ওর কাছ থেকে চিয়েচিন্তে চলেন। অথচ মাসুদ রানা তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিল, ‘আমি বড়লোক হতে চাই। বড়লোক হয়ে আমার আম্মুকে ভালো রাখব, আর মাটি কাটতে দিব না।’

পুনশ্চ: দেশে পথশিশু, গৃহহীন ও উপার্জনের দায়ভারগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যা কত, তা কারোরই জানা নেই। কিন্তু তাদেরও ক্ষুধা আছে, মানুষের শিশুর মতো আকাঙ্ক্ষা আছে, তা নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি। আর এখন তো দুর্বিষহ করোনাকাল, এখন তারা কীভাবে টিকে আছে? সামনে ঈদ ও জাকাতে তাদের কথা যেন আমরা মনে রাখি।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]