এবার দুর্গতি থেকে মুক্তির প্রার্থনা

সোমবার প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে পাঁচ দিনের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা
ছবি: বাসস

দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনীরূপেই পূজিত। শাস্ত্রীয় নিয়মে দুর্গাপূজা শরৎ ও বসন্তকালে আয়োজনের বিধান থাকলেও শারদীয় পূজাই প্রাকৃতিক কারণে বাঙালি হিন্দুসমাজ প্রধান উৎসবরূপে গ্রহণ করেছে। এই পূজার আগমনী বার্তা ঘোষিত হয় আগেই। প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় উৎসবের। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম।
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। বিশ্বে প্রতিদিনই মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও। বাংলাদেশেও মৃত ও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। জীবন-জীবিকার ওপর বিস্তৃত হয়েছে করোনার থাবা। মানবজাতির এই ভয়ংকর ‘দুর্গতি’র মধ্যেই দুর্গতিনাশিনী মা এসেছেন।
এবার মা এসেছেন দোলায়, শাস্ত্রীয় নিয়মে মড়ক অবশ্যম্ভাবী। তার আলামত আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি। করোনাসৃষ্ট ভয়াবহ মহামারির মধ্যেই মা এসেছেন। তবে সুসংবাদও আছে। মা পূজার পরে যাবেন গজে চড়ে, এর ফল শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। অন্ধকারের পরে সূর্যোদয়, দুর্যোগের পরে আলোর বন্যা। এ তো প্রাকৃতিক নিয়ম। তার ব্যত্যয় হতে পারে না। নইলে সৃষ্টি থাকে না। এবারের দুর্গাপূজা তাই সমৃদ্ধির আগমনী বার্তাও ঘোষণা করছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা মানবজাতির জন্যই সমৃদ্ধি ও কল্যাণের বার্তা। দুর্গতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেই দুর্গতিনাশিনীর মর্ত্যে আগমন। মায়ের আশীর্বাদে করোনাসৃষ্ট বিপর্যয় অবশ্যই পরাজিত হবে, কেটে যাবে দুঃসময়।
মহামারির মধ্যেই মাতৃ-আরাধনা। স্বাভাবিকভাবে পূজায় মহামারির প্রভাব পড়েছে। পাঁচ দিনের পূজা। এবারের ধারা ব্যতিক্রম। মহালয়ার এক মাসের বেশি সময় পর দুর্গাপূজা হচ্ছে।
মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এবার বিরাজিত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সন্তানেরা মায়ের পূজা–অর্চনা করবেন, অঞ্জলি দেবেন। প্রার্থনা জানাবেন শান্তি-সমৃদ্ধির, মহামারি থেকে মানবজাতির মুক্তির, অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই এই প্রার্থনা। বিপর্যয়ের পর নতুন জীবনের প্রার্থনা। বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ সপ্তমী পূজার দিন করোনা থেকে মানবজাতির মুক্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনার কর্মসূচি রেখেছে। এটা আমাদের ঐতিহ্য, যা জন্মাষ্টমীর গীতাযজ্ঞে মানুষের সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্রার্থনা থেকে উৎসারিত হয়েছে।
করোনার কারণে এবারের উৎসব–আনন্দ আয়োজন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পূজা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, স্বাভাবিকভাবে ভক্তসমাগম কম হতে পারে। পূজার দুটি দিক—একটি সামাজিক, অন্যটি ধর্মীয়। মায়ের পূজায় ভক্তরা অংশ নেবে, অঞ্জলি দেবে, হৃদয়ের আকুতি ব্যক্ত করবে মায়ের কাছে। মায়ের আরতি হবে। পরিবারের সবাই শরিক হবে পূজায়। মায়ের পূজায় হৃদয়ের দিকটি বড়। পাঁচ দিনব্যাপী পূজায় নানা আনুষ্ঠানিকতা, প্রতিটি অনুষ্ঠান গভীর অর্থবহ। ধর্ম ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই সবার অংশগ্রহণে পূজা হয় সর্বজনীন।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই সামাজিক মেলবন্ধনের, সহজ কথায় পূজার সামাজিক দিকটি। সেটাই পূজার উৎসব। শারদীয় দুর্গাপূজা মূলত বাঙালির উৎসব। প্রতিটি পরিবারে এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই সবার সম্মিলন ঘটে। মা আসছেন, তাই পরিবারের সব সদস্য একত্র হওয়ার চেষ্টা করেন। আগে দেখা যেত শারদীয় দুর্গাপূজায় বাঙালি ঘরে ফিরত, সারা বছরের মধ্যে বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের এটা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা বড় উপলক্ষ। তৎকালীন সামাজিক অবস্থার বিবরণ থেকে জানা যায়, তখন পারিবারিক পূজা ছিল বেশি। সর্বজনীন বা বারোয়ারি পূজা ছিল কম। তবু পূজায় বাড়ি ফিরতেন সবাই। লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত অবস্থান করতেন, এরপরই কর্মস্থলে ফেরার পালা। তাই পূজাই ছিল কার্যত পারিবারিক উৎসব। দেশের সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কয়েক বছরে পূজা বেড়েছে। বলা যায় বাড়ির কাছেই পূজা। বেড়েছে সম্পৃক্ততা। সারা দেশে ৩২ হাজারের মতো পূজা হয়েছে গত বছর। এবার প্রায় এক হাজার পূজা কম হচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে এ বছর পূজা আরও বাড়ত।
অবশ্যই এ অবস্থা সাময়িক, করোনাকাল কেটে যাবে, আবার উৎসব ফিরবে উৎসবের আঙ্গিকে। তবে এবার সামাজিক সম্মিলনে যে ব্যাঘাত ঘটবে, আমরা সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুস্থ ও সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারি কিছুটা। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে পূজার সৌন্দর্য ব্যাহত হওয়ার মতো কিংবা ধর্মীয় চেতনা ক্ষুণ্ন হতে পারে—এমন কিছু যেন না হয়। যোগাযোগ বৃদ্ধিই উৎসবের ঘাটতি পূরণ করবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক