এবার না হয় মানুষ হই


প্রতি বছর নারী দিবস আসলেই আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই। এক ভাগ মুখ বেঁকিয়ে বলে, সমতাও চায় আবার দিবসও চায়—এই হলো নারী। আর এক ভাগ আছেন যারা মনে করেন, অবশ্যই নারী দিবস পালন করা দরকার। এই যে এত ত্যাগ, এত লড়াই, এত যুদ্ধ—এই সব কিছুরই তো একটা স্বীকৃতি দরকার! শেষের দলের মানুষেরা বিশ্বাস করেন যে এভাবেই একদিন ধীরে ধীরে সব অসমতা দূর হবে।

কোন দল ঠিক আর কোন দল ভুল, তা নিয়ে অবশ্য আজ লিখতে বসিনি। আজ বরং অন্য কথা বলি। আজ মূলত যা নিয়ে কথা বলতে চাই, তা হলো সম্মান। অবশ্য-অবশ্যই নারীদের সম্মান করা উচিত—এই কথা তো আমাদের আশপাশের সব মানুষই বলে! তাহলে? তাহলে কারা নারীদের অসম্মান করছে? তাহলে কেন প্রতিদিন আমরা ধর্ষণ, নারী অবমাননা, টিজ, এই ধরনের খবরগুলো পড়ছি, দেখছি? এইগুলো কারা করে?

মূল সমস্যাটা হয়তো অন্য জায়গায়। মানুষের জীবনে কি হয়? পথে চলতে চলতে নানা রকম মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়। কারও সঙ্গে কাজের সূত্রে, কারও সঙ্গে বন্ধুদের মাধ্যমে, কারও সঙ্গে হয়তো কোনো দুর্ঘটনাবশতই পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্র ধরে কারও কারও সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়। তারা কাছাকাছি আসে। মনে হতে থাকে এরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারবে না। সমস্যাটা শুরু হয় তখনই যখন মতের অমিল হতে শুরু করে। দেবতাটি তখন হয়ে ওঠে জীবনে দেখা সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। তখন তার এই সমস্যা, ওই সমস্যা, নানা রকম কিছু চোখে পরতে শুরু করে। শুধু চোখে পরলে সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা অন্যকে জানানোর জন্য প্রাণ আইঢাই করে। নইলে আর এক সময়ের সঙ্গী হিসেবে আরেকজনের সার্থকতা কোথায়?

অপরপক্ষকে ঘায়েল করতে ছেলের বাড়ির সামনে বিষের বোতল হাতে মেয়েদের বসে পড়তে আমরা দেখেছি! বিয়ে করো-এই দাবি নিয়ে! জোর করে তুলে নিয়ে এক সময়ের খুব প্রিয় মানুষের সম্ভ্রমহানি করতে আমরা শুনেছি। তা আবার ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কত কত কাহিনি কেচ্ছা হচ্ছে চারপাশে প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত। এই কাজগুলো যারা করছে তারা বেপরোয়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খানিকটা কম শিক্ষিত! আরও এক ধরনের মানুষ কিন্তু আছে আমাদের মাঝে। তথাকথিত পড়াশোনা করা মানুষ। এদেরও একটা অস্ত্র আছে। সম্পর্ক ভেঙে গেলে এই তথাকথিত শিক্ষিতরা পুরো দুনিয়াকে জানান দেয়, কীভাবে তারা আলাদা হয়ে গেল! এখন তো আবার ফেসবুকের জমানা! যা ইচ্ছে লিখে দিলেই হলো! ব্যাস! আমরা ভাইরাল!

অতিসম্প্রতি আমাদের খুব প্রিয় দুই তারকা দম্পতির দীর্ঘ সাংসারিক জীবনের বিচ্ছেদ ঘটেছে। কিন্তু খুব অবাক করা বিষয়, কেন তাদের এই বিচ্ছেদ হলো বিনোদন সাংবাদিকেরা পর্যন্ত বের করতে পারে নাই। তারা কেবল তাদের একসঙ্গে থাকার ভালো সময়গুলোর দোহাই দিয়েই সকলকে জানিয়েছেন যে তারা এখন আর একসঙ্গে ভালো থাকতে পারছেন না, তাই আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। আমরা অধিকাংশ কী করি? নোংরা ছড়াই, গন্ধ ছড়াই।

আমরা ভুলে যাই, যেই মানুষটাকে নিয়ে সকলের কাছে আজে বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছি, একই সঙ্গে দাবি করছি তাকে ভালোবাসি—বিষয়টা বিপরীত হয়ে গেল না? আমরা একবারও ভাবছি না, যে নোংরা আমি অন্যের গায়ে লাগানোর চেষ্টা করছি, তা আমার হাত থেকেই ছড়াচ্ছে, আমার হাতেও লেগে যাচ্ছে। নোংরাটা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমি নিজেই নোংরা হয়ে যাচ্ছি বা গেছি। বেমালুম ভুলে যাই! সমস্ত খেয়াল তো ওই মানুষটার দিকে। তার গায়ে কতটা ময়লা লাগল সেই দিকে!

অথচ বিষয়টা অন্য রকম হতে পারত না? বিষয়টা তো এমনও হতে পারত, যে কোনো কারণেই হোক, একজন যখন সম্পর্কে জড়াতে চাইছে না বা সম্পর্কে আর থাকতে চাইছে না, তাকে জোর না করা, তার সম্পর্কে মুখরোচক কথা না বলা, তাকে নিয়ে কথা না বলা। আমাদের দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের চরিত্র বিষয়ক নোংরা ছড়ানো হয়। আর আমাদের এই সমাজ এই নোংরা গল্প শোনেও ভালো, নেয়ও ভালো, ছড়ায় ভালো।

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসেও আমরা কি সত্যিকারের সম্মান দেওয়া শিখতে পারি না? বন্ধ করতে পারি না মেয়েদের নিয়ে মুখরোচক গল্প? একটা মেয়ে যদি তার সংসার ছেড়ে, তার সম্পর্ক ছেড়ে নিজের মতো করে থাকতে চায়, তার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে তাকে সম্মান জানাতে পারি না? পারি না তাকে তার মতো করে বাঁচতে দিতে? তাকে তার মতো থাকতে দিতে? তাকে তার জীবন তার মতো কাটাতে দিতে? একটা নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারি না? পারি না? শুরুতেই যে সম্মানের কথা বলছিলাম, এটাই সম্মান!

মাহবুবা সুলতানা প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী