এভাবে পেটে-পিঠে মারবেন না

লকডাউনে রিকশা চালানোর জন্য পুলিশ রিকশাগুলোকে রাস্তায় উল্টিয়ে রেখেছে। ১৭ এপ্রিলের ছবি।
ছবি: দীপু মালাকার

রিকশাওয়ালারা হলেন সেই ঝি, যাকে মেরে বাকিদের শেখানো হচ্ছে লকডাউন মানে কী। ছবিগুলো ফেসবুকে ও গণমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা মার খাচ্ছেন, তবু ট্রাফিক পুলিশকে চাকা ফুটো করতে দিচ্ছেন না, ভাঙা রিকশার সামনে বসে কাঁদছেন, পুলিশের হাতে-পায়ে ধরছেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি ঘটে বদ্ধ পরিবেশে: ব্যাংকে, অফিসে, কারখানায়, জানালাবদ্ধ ব্যক্তিগত গাড়িতে। করোনার দোহাইয়ে রিকশাচালক দমনের যুক্তি তাই ধোপে টেকে না।

মানুষ কেন, তামাম জাহানে কোনো প্রাণীই বিনা বাধায় মৃত্যুবরণ করে না। কোনো প্রাণীই ক্ষুধার আগুন পেটে নিয়ে বরফের মতো জমে বসে থাকে না। তারা মরার আগে নড়াচড়া করে, ক্ষুধা মেটাতে এদিক-সেদিক বের হয়। তখনই প্রবাদটা সত্য হয়, ‘মরারে মারো ক্যা? কয়, লড়ে-চড়ে ক্যা?’

এমন কোনো রিকশাচালক নেই, যিনি রাস্তায় নেমে কখনো না কখনো মার খাননি। লকডাউনে রিকশা নামিয়েও মার খাচ্ছেন, অন্য সময় আরোহী কিংবা পুলিশ, কিংবা গাড়িচালকেরাও তাঁদের মারেন। তাঁদের সঙ্গে তুই-তোকারি করেন। ক্ষমতা নিম্নগামী, আর রিকশাচালকেরা হলেন ক্ষমতা ও মর্যাদার মইয়ের সবচেয়ে নিচের ধাপ। তাঁদের ওপর পা দিয়েই বাকিরা ওপরে ওঠেন।

তাঁরা ভিক্ষা করেন না। গায়ে খেটে খাওয়া-থাকা বাদে বাকি সব টাকা গ্রামে পাঠান। এই টাকায় সন্তানের পড়ালেখা হয়, চাষের জন্য নগদ পুঁজির জোগান হয়। গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা যে শহরে চলে আসে, রিকশাওয়ালা আর শ্রমিকের হাত দিয়ে তার সামান্য একটা অংশ আবার গ্রামে ফেরত যায়। রিকশাওয়ালার গায়ে হাত দেওয়া, পেটে লাথি মারা মানে তাই কৃষককে মারা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে বাধ্য করা।

গল্পটি ইংরেজ আমলের। এক সম্ভ্রান্ত বাবু কী এক দরকারে চাকরকে ডাকলে জবাব আসে, ‘হুজুর, আমি আহার করছি।’ বাবুর মেজাজ চড়াং করে চড়ে, ‘আহার করছিস! তুই কি লাটসাহেব নাকি! মহারানি ভিক্টোরিয়া করেন ভোজন; আহার করেন লাটসাহেব, আর আমি খাই, তুই গিলিস।’ কর্ম একই কিন্তু কর্তা ভেদে তার ইজ্জত আলাদা। মহামারি ঠেকানোর লকডাউনের নিষেধ নিচুতলার জন্য যতটা কড়া, উঁচুতলার জন্য ততটাই নরম।

লকডাউন যদি কোনো পেশার জন্য শিথিল করা হয়, তাহলে স্বাস্থ্যকর্মীর ও খাদ্যপণ্য সরবরাহকারীদের পর রিকশাচালকদের নাম আসা উচিত। কিন্তু এ কেমন লকডাউন, যেখানে আকাশে বিমান উড়বে, মাটিতে প্রাইভেট কার ও ব্যক্তিগত মোটরযান মোটামুটি চলবে। কিন্তু যা চালিয়ে পেটে ভাত জোগানো হয় এবং যাতে করে শ্রমজীবীরা মজুরি খাটতে যান, সেগুলো চলবে না। রিকশার চাকা না চললে, শেয়ার রাইডিংয়ের মোটরসাইকেল না দৌড়ালেও অনেকের পেট চলবে না। না চলুক, কার তাতে কী? খাদ্য আছে গুদামে, টাকা আছে কোষাগারে, যাদের ঘরে সব আছে তাদের ঘরে থাকা মানায়, যাদের নাই তাদের জন্য ঘর বন্দী থাকা ক্ষুধার্ত জেলবাসের সমান।
শহরের পিচ রাস্তায় খেটে খাওয়া যে লোকটাকে রিকশাওয়ালা বলা হয়, গ্রামদেশে তিনিই ছোট কৃষক কিংবা কৃষির মজদুর। দেশটাকে তাঁরাই ভর্তুকিতে খাওয়ান। কারণ, ন্যায্য দামটা তাঁরা পান না। তারপরও তাঁদের নাম হয় ‘হাইলা চাষা’ আর শহরের বাবুরা তাঁদের ডাকেন ‘মফিজ’ বলে। সেই তিন চাকা চালানো কৃষক মানুষগুলোর প্রতি এত বিদ্বেষ কেন?

করোনায় তাঁদের জন্য কী করা হয়েছে? তাঁরা কীভাবে খাবেন, কীভাবে পেট চালাবেন, সেই কথা কী ভাবা হয়েছে? সরকারি সাহায্যের ফিরিস্তি শুনে পুরান ঢাকার চোখে ঠুলি পড়া ঘোড়াগুলোও হাসবে। এমন অবস্থাতেই গরিবের দুঃখের ভাষা এক পথশিশুই দিতে পারে, ‘সামনে ঈদ, আমরা খাব কী? এই লকডাউন ভুয়া। থ্যাংক ইউ।’ কথাটা গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে বলেছিল এক ভাসমান কিশোর। পরে জানা গেছে, এই সত্য বলার জন্য তাকে মার খেতে হয়েছে। তার ভাইরাল ভিডিওর পর ফোলা চোখ-মুখের ছবিও ভাইরাল হয়েছে। ক্ষমতা ও ধর্ম বিষয়ে যাদের অনুভূতি লজ্জাবতী লতার মতো কাতর, মানুষের বাঁচার ফরিয়াদে সেই অনুভূতি কায়দা করে অবশ হয়ে যায় কী করে?

নগরের রিকশাওয়ালা এক সার্বক্ষণিক হতাশ, অবসন্ন ও মার খাওয়া চরিত্র। আরোহীর মার, ট্রাফিকের মার, পুলিশের মার, বাড়িওয়ালা ও মহাজনের মার, গাড়ি-ট্রাকের মার, ছিনতাইকারীর মার, রিকশা উচ্ছেদের মার, মুক্তবাজারি দ্রব্যমূল্যের মারসহ দুনিয়ার যাবতীয় মার যাকে প্রতিনিয়ত সইতে হয়, সেই-ই রিকশাওয়ালা। বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধেও কথা বলার লোক থাকে, আন্দোলন হয়। কিন্তু রিকশা উচ্ছেদ আর পথেঘাটে রিকশাচালকদের পীড়ন করায় কোনো দোষ নেই। বড়লোকেরা রিকশা চড়েন না। চড়েন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। এ দুয়ের খিটমিট ও বিবাদ পথচলতি দৃশ্য।

রিকশাওয়ালা আর তাঁর আরোহীরা যেন পরস্পরের শ্রেণিশত্রু। রিকশাচালক মনে করেন আরোহী তাঁকে ঠকায়, আর আরোহী মনে করে রিকশাওয়ালা প্রতারক। কিন্তু সরল প্রশ্ন; দুর্বলের দিক থেকে সবলকে ঠকানোর সুযোগ আসলে কতটা?

নিচে পিচের ভাপ আর ওপরের খরতাপের মাঝখানে যে লোকটি গরুর ভঙ্গিমায় মানুষ টানে, সে কি আর মানুষ? যে মানুষ অপর মানুষকে বহন করে, সে আসলে মানবেতর। এই কাজ আগে গাধা-ঘোড়া-গরুতে করত, এখন তারা করে। রিকশাচালকদের প্রতি ওপরতলার রগরগে শ্রেণি বিদ্বেষের প্রতিফলন হলো তাঁদের প্রতি পুলিশের আচরণে।
রিকশাচালকদের অর্থসহায়তা দিন, বস্তিতে ত্রাণ পৌঁছান। নইলে পেটের ডাকের কাছে সামাজিক দূরত্বের ডাক কোনো অর্থই বহন করবে না। সবচেয়ে ভাগ্যাহত মানুষগুলোকে এভাবে পেটে-পিঠে মারবেন না। ভাত না দিয়ে কিল মারার এই গোঁসাইগিরি নিষ্ঠুরতা।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]