এমন বন্ধু থাকলে শত্রুর কী দরকার?

ফিলিস্তিনের নামজাদা শিল্পী উমাইয়া জুহার একটি কার্টুন এ রকম: একজন ফিলিস্তিনি নারী, একটি হাত পেছন থেকে ছুরি মারছে তাঁর পিঠে, আরেকটি হাত সামনে থেকে ছুরি মারছে তাঁর বুকে। প্রথম হাতটি একজন আরবের, অন্যটি ইসরায়েলের।

গত ৭০ বছরের ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের বারবার এ রকম আরব বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটি গত বছরের শেষ মাসে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রশ্নটি ঘিরে। প্রথমে নিরাপত্তা পরিষদে ও পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই প্রশ্নে যে ভোট হয়, তাতে আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বটে, কিন্তু পর্দার অন্তরালে তাদের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তটি সঠিক, তাই তা ফিলিস্তিনিদের মেনে নেওয়া উচিত—এমন যুক্তি দেখানো শুরু করে। এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে আরব বিশ্বের অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় দেশ মিসর।

খবরটা দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটি লিখেছে, মিসরের টিভি দর্শকদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমের স্বীকৃতি আর পশ্চিম তীরের রামাল্লাহকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির মধ্যে কোনো তফাত নেই। একাধিক টেপ রেকর্ডিং শুনে দেখা গেছে, মিসরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা টিভির টক শোর বক্তাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে স্বীকৃতির যে ঘোষণা করেছে, তা নিয়ে যেন বেশি কথা তাঁরা না বলেন। কারণ, এর ফলে শুধু হামাস ও ইসলামপন্থীদের উসকে দেওয়া হবে।

আশরাফ আল খোলি নামের এক মিসরীয় সামরিক কর্মকর্তার চারটি রেকর্ডিং নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে আছে। তার একটিতে ক্যাপ্টেন খোলিকে বলতে শোনা যায়, ‘দেখুন, সব আরব ভাইয়ের মতো আমরাও (আমেরিকার সিদ্ধান্ত) নিন্দা করি। (কিন্তু) যখন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতায় পরিণত হবে, ফিলিস্তিনিদের সাধ্য নেই তা ঠেকায়। আর আমরা তো এ নিয়ে নতুন এক যুদ্ধে যাব না। এমনিতে আমাদের নিজেদেরই সমস্যার অন্ত নেই।’

বলা বাহুল্য, ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্র নেই এবং রামাল্লাহ তার রাজধানী নয়। এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। যেদিন সত্যি সত্যি স্বাধীন ফিলিস্তিন নামের রাষ্ট্রটি গঠিত হবে, পূর্ব জেরুজালেম হবে তার রাজধানী, ফিলিস্তিনি ও বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের সেই আশা। নিরাপত্তা পরিষদে এক যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি ১৪টি সদস্যরাষ্ট্র গত মাসেও তাদের ভোটের মাধ্যমে সে সম্ভাবনায় তাদের আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাহলে মিসর মুখে এক কথা আর পেছন থেকে অন্য কথা কেন বলছে?

উত্তরটা খুব কঠিন নয়। আজকের কোনো আরব দেশই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুপাক্ষিক রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের প্রতিষ্ঠা চায় না। তাদের নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থা হয় রাজতন্ত্র, নয়তো আধা সামরিক একনায়কতন্ত্র। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন তাদের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরবদের বিশ্বাসঘাতকতা সাত দশকেরও বেশি পুরোনো। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল হয় মিসর নয়তো জর্ডান দখল করে নেয় ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের জন্য নির্ধারিত পুরো অঞ্চলই ইসরায়েলের অধীনে চলে যায়, আরও যায় সিনাইতে মিসরের নিজস্ব জমি। ১৯৭৩ সালে মিসর সে জমি পুনরুদ্ধারের পর ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

পরবর্তী ৩০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একটা বড় গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। একদিকে শিয়া রাষ্ট্র ইরানের উদ্ভব, অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদ—এই দুই পরিস্থিতিতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক আঁতাতের নতুন মেরুকরণ ঘটে। সৌদি আরব, মিসর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য ইসরায়েলের মোকাবিলার চেয়ে অনেক জরুরি হয়ে পড়ে ইরানের সামরিক আধিপত্য ঠেকানো। ফলে পুরোনো অসদ্ভাব ঝেড়ে ফেলে এই দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে গোপনে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যে, কৌশলগত আঁতাতে জড়িয়ে পড়ে। এই আঁতাতের একটি অনিবার্য বলি হয় ফিলিস্তিন।

এই মুহূর্তে স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার মতো ক্ষমতা ফিলিস্তিনের নেই। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি আরব রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সীমানা বরাদ্দ রেখেছিল, এখন তার অর্ধেকও ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে তাদের জমির ওপর প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ইহুদির জন্য বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া, পশ্চিম তীরের এক শহর বা গ্রাম থেকে অন্যত্র যেতে হলে ইসরায়েলি চেকপোস্টের অনুমতি চাই। বছর পাঁচেক আগে ইসরায়েলি চেকপোস্ট পেরিয়ে আমাকে পশ্চিম তীরে যেতে হয়েছিল। মনে আছে, জাতিসংঘের গাড়ি নিয়েও সে চেকপোস্ট পেরোতে আমাকে অর্ধেক দিন নিরাপত্তা প্রহরীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আরব হলে তো কথাই নেই। সমুদ্রসীমা বন্ধ, নিজস্ব কোনো বিমানবন্দর নেই, নিজ সীমান্তের ভেতর কাজের কোনো সুযোগ নেই, ভালো কোনো স্কুল বা হাসপাতাল পর্যন্ত নেই। টিকে থাকার জন্য নির্ভর করতে হয় জাতিসংঘের ওপর অথবা বিদেশি সাহায্যের ওপর। এমন একটা দেশ স্বাধীন হয়েই–বা কী করবে? একসময় আরব দেশগুলো নিজের দেশের মানুষের অসন্তোষ ঠেকাতে বেশ উদার হস্তেই ফিলিস্তিনিদের অর্থ সাহায্য দিয়েছে। এখন তা–ও বন্ধ। অবস্থা এতটা গুরুতর যে বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য না এসে পৌঁছালে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের কর্মচারীদের মাসিক বেতন জোগানোই অসম্ভব।

অধিকাংশ আরব দেশ শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, প্রবল স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ। যেকোনো দুর্নীতপরায়ণ ও স্বেচ্ছাচারী দেশের মতো তাদেরও প্রধান ভয় দেশের জনগণকে। জনগণ যদি খেপে ওঠে, বাক্স-পেটরা ও হাতানো ডলারের বস্তা নিয়ে এসব দেশের নেতারা পালাবেন কোথায়? মানুষ যে খেপে উঠতে পারে তার প্রমাণ রয়েছে, ২০১১ সালে তিউনিসিয়া থেকে ইয়েমেন, প্রায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই এক অভাবিত ‘আরব বসন্ত’ আগুনের গোলার মতো ফেটে পড়ে। বড় ধরনের কোনো বিপদ ঘটার আগেই সে আগুন নেভানো গেছে, কিন্তু আবারও যে একই ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তা যাতে না ঘটে, সে লক্ষ্যে উদ্বিগ্ন আরব রাজা-রাজড়ারা ইসরায়েলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার উদ্যোগ নেয়। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কেনা গোলাবারুদ ও ভাড়াটে লেঠেল দিয়ে গণতান্ত্রিক বিস্ফোরণ ঠেকানো গেছে, কিন্তু বারাক ওবামার সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে ক্রমশ নিজেদের গুটিয়ে নেয়। রাজা-রাজড়াদের প্রয়োজন পড়ে নতুন লেঠেলের। আর সেই শূন্যস্থানে ঢুকে পড়ে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের আলোচনা গোপনে গোপনে অনেক দিন থেকেই চলছিল। ২০০২ সালে এই আলোচনা একটি সুনির্দিষ্ট রূপ নেয়। তথাকথিত ‘আরব শান্তি উদ্যোগ’ নামে এক ফর্মুলার অধীনে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের বদলে দেশটিকে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়। কাগজে-কলমে এই উদ্যোগের লক্ষ্য সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বলা হলেও আসল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের ঘাড়ে বন্দুক রেখে একদিকে ইরানকে ঠেকানো, অন্যদিকে হামাসসহ সব জঙ্গি আন্দোলনকে কোণঠাসা করা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রক্রিয়া আরও তীব্রতা পায়। এই নতুন প্রশাসনের চাপেই আরবরা ইসরায়েলের সঙ্গে খোলামেলাভাবে গাঁটছড়া বাঁধে। বস্তুত, ২০১৭ সালে সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনে কোনো শর্ত ছাড়াই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত বলে জানায়।

আরব ও ইসরায়েলের এই সখ্যের ফল দাঁড়াল এই যে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ায় এমন আর কেউ থাকল না। এমনিতেই সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য ছাড়া তেমন কিছুই আরব দেশগুলো করেনি, এখন ইসরায়েলকে খুশি করতে সে সাহায্যও কমে এসেছে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা ফিলিস্তিন প্রশাসন প্রত্যাখ্যান করায় হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তারাও ফিলিস্তিনিদের কোনো রকম অর্থ সাহায্য দেবে না। শুধু সরাসরি সাহায্য নয়, জাতিসংঘের মাধ্যমে যে সাহায্য যেত, দরকার হলে সে সাহায্যও বাতিল করা হবে।

সন্দেহ নেই, ফিলিস্তিনিরা তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যময় এক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গেছে, হাঁটু মুড়ে এসেছে। একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা এখন ক্লান্ত, পর্যুদস্ত। এই এলাকায় নতুন আরেক ‘ইন্তিফাদা’ ফেটে পড়বে, তেমন সম্ভাবনাও কম। একমাত্র আশা, তা–ও অতি ক্ষীণ, তা হলো আরব দেশগুলোয় আরেক ‘আরব বসন্তের’ সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ ফিলিস্তিনের সঙ্গে অবিচারের কথা জানে, এই অবিচার তাদের নিজের বিরুদ্ধে অবিচার, এই কথা তারা ভাবে। এই মনোভাব যে আগামী দিনে নতুন বিস্ফোরণে পরিণত হবে না, এ কথা কে বলতে পারে? আর তেমন বিস্ফোরণ ঠেকাতেই যে মিসর সরকারের গোয়েন্দারা দেশের মানুষের কানে ফুসমন্তর দিচ্ছেন, রামাল্লাহ আর জেরুজালেমের তফাত কী—তাতেও কোনো ভুল নেই।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।