এমাজউদ্দীন আহমদ সংকীর্ণতা এড়িয়ে চলতেন

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: আবদুস সালাম
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: আবদুস সালাম

সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সহ–উপাচার্য, প্রক্টর, হলের প্রাধ্যক্ষ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর উচ্চতর ডিগ্রি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে।

এমাজউদ্দীন আহমদকে আমি সহকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদাধিকারী হিসেবে কাছে থেকে দেখেছি। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে আমি একমত ছিলাম না। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। সেটি উপাচার্য পদে থাকতে যেমন, তেমনই হলের প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবেও। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে একাধিক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা তিনি সেখান থেকেই অর্জন করেছিলেন।

ছাত্রজীবনে এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গ যুক্ত ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় জেলও খেটেছেন। তিনি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাহচর্য পেয়েছিলেন প্রথমে ছাত্র হিসেবে, পরে সহকর্মী হিসেবে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উদারনৈতিক চিন্তাধারাও এমাজউদ্দীনের মানস গঠনকে প্রভাবিত করেছে বলে আমার মনে হয়।

এমাজউদ্দীন আহমদ ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের মনোনয়নে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষকদের তিনটি দল ছিল। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাম ঘরানার শিক্ষকদের গোলাপি দল, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নীল দল ও বিএনপির সমর্থকদের সাদা দল। আমরা গোলাপি দলে ছিলাম। প্রথম দিকে এমাজউদ্দীন আহমদও গোলাপি দলে ছিলেন। পরে তিনি সাদা দলে নেতৃত্ব দেন।

কিন্তু উপাচার্য পদে থাকতে তাঁকে দেখেছি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে। তিনি সংকীর্ণ মনোভাব নিয়ে চলেননি। সহকর্মী হিসেবে তিনি আমাকে কাছে টানতে চাইতেন। তিনি আমাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন; প্রক্টর হতে বলেছিলেন। আমি রাজি হইনি। তবে তাঁর অনুরোধে একবার আমি সিনেটের সদস্য হয়েছিলাম। তিন বছরের জন্য। সে সময়ে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ কী করে নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে তিনি সচেষ্ট ছিলেন।

আওয়ামী লীগের সমর্থক নীল দল ও বিএনপির সমর্থক সাদা দল সব সময় মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। এক পক্ষের কথা অপর পক্ষ মানতে চাইত না। কিন্তু এমাজউদ্দীন আহমদ সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করতেন। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে তিনি নীল দলের শিক্ষকদের সঙ্গে বসতেন। তাঁদের অভিযোগ ও দাবিদাওয়ার কথা শুনতেন। ওই তিন বছরে সিনেট বৈঠকে নীরব থাকাকেই আমি শ্রেয় মনে করেছি। তারপরও দুটি বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কিছু কথা বলেছি। আমার বক্তব্যের প্রতি উপাচার্যের ব্যক্তিগত সমর্থন ছিল।

কিন্তু সিনেটে যেকোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা যে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেন না, তার বহু প্রমাণ আছে। কোনো বিষয়েই সাদা ও নীল দলের শিক্ষকেরা একমত হতেন না। সাদা দলের শিক্ষকেরা কোনো কথা বললে নীল দলের শিক্ষকেরা তা মানতে চাইতেন না। আবার নীল দলের শিক্ষকেরা কোনো কথা বললে সাদা দলের শিক্ষকেরা তার বিরোধিতা করতেন। এর মধ্যেও এমাজউদ্দীন আহমদ সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করতেন। যত দিন গোলাপি দল সক্রিয় ছিল, তত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সহিষ্ণু পরিবেশ ছিল। পরে ভাঙাভাঙি হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি পাল্টে যায়।

স্বাধীনতার পর যে কজন উপাচার্য দক্ষতার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনা করেছেন, এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের একজন। এমনকি ফজলুল হালিম চৌধুরী যে আট বছর সুনামের সঙ্গে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন, তার পেছনও এমাজউদ্দীন আহমদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান যা–ই থাক না কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে দেখেছি।

এমাজউদ্দীন আহমদ অনেক বই লিখেছেন। তাঁর লেখা পাঠ্যবইগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি গ্রামার বই লিখেছেন। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই লিখেছেন। এসব বইয়ের গুরুত্ব আছে। কিন্তু আমি মনে করি, ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে এমাজউদ্দীন আহমদের লেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের এখানে অনেকে ম্যাকিয়াভেলির নিন্দা করেন। কিন্তু এমাজউদ্দীন আহমদ দেখিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি প্রথম আধুনিক রাষ্ট্রের চিন্তা করেছেন, যা হবে ধর্ম ও রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত। ম্যাকিয়াভেলির অনেক চিন্তার সঙ্গে আমরা দ্বিমত করতে পারি। কিন্তু তিনি বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা করেছেন। টমাস হবস, জন লক, জাঁ জাক রুশো প্রমুখ দার্শনিক–রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যে আধুনিক রাষ্ট্রের তত্ত্ব দিয়েছেন, তার অনেক আগে ম্যাকিয়াভেলি এসব কথা বলেছেন। ইউরোপে ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমাদের দেশে তেমন আলোচনা হয়নি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতি নিয়েও এমাজউদ্দীন আহমদ অনেক বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বিএনপি যেভাবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা দেন, তিনি সেভাবে দেননি। আবার পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিগত সাযুজ্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্যের কথাও তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন।

আমাদের রাজনীতির ইতিহাস সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ জানতে হলে যাঁদের বই পড়তে হবে, এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের অন্যতম। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে তাঁর কৃতির অবসান ঘটবে না। তাঁর চিন্তা, তাঁর লেখা বইগুলো এবং তাঁর জীবন ও কর্মের স্মৃতি আমাদের জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: লেখক ও চিন্তক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক