এরদোয়ান কি জুয়াড়ি, নাকি ক্ষমতা বিস্তারের দাবাড়ু

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি: এএফপি

অটোমান সুলতান সেলিম আধুনিক ‍দুনিয়াকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছেন। এমন দাবি আমেরিকান ইতিহাসবিদ অ্যালান মিখাইলের। ২০২০ সালে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের নাম ‘সুলতান সেলিম, হিজ অটোমান অ্যাম্পায়ার, অ্যান্ড দি মেকিং অব মডার্ন ওয়ার্ল্ড’। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (আরবিতে রজ্জব তৈয়ব রিদওয়ান) নিজেকে সম্ভবত অটোমান সাম্রাজ্যের নবম শাসক সুলতান সেলিমের আদলে ভাবতে চাইছেন।

কতটা হবেন, কতটা পারবেন, তা নিয়ে জল্পনা আছে। তার আগে এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রধান ভূরাজনৈতিক মঞ্চে কী ঘটছে, তা দেখা যাক। ইউরোপকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে মোকাবিলায় নেমেছে। তার আগে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়েছে, ইরাকেও ভাড়াটে সেনা রেখে সরে আসার পথে কাজ করছে। চলে আসবার আগে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ভার দিয়ে আসা হয়েছে তুর্কি সেনাদের, যাতে ন্যাটো বিমান ওই বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে। এ মুহূর্তে সাবেক সোভিয়েত প্রদেশ ইউক্রেন রুশ সীমান্তে গোলাবর্ষণ করছে। ইউক্রেন থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রুশ-অধ্যুষিত অঞ্চল রাশিয়ার কাছ থেকে ফিরে পেতে চায় ইউক্রেন। আর ইউক্রেনকে সাহায্য করছে কে? তুরস্ক। আজারবাইজানের হাতে আর্মেনিয়ার পরাজয়ের তুরুপ ছিল তুর্কি ড্রোন। সেটাই এখন ইউক্রেন ব্যবহার করছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। কিরগিজস্তানের স্বৈরশাসকেরও ভরসা হয়ে আছেন এরদোয়ান।

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী তুরস্ক। এখন তারা অভিযান চালাচ্ছে মার্কিন-সমর্থিত কুর্দিদের বিরুদ্ধে। কুর্দি দমনের অজুহাতে ইরাকের ভেতরে অস্থায়ী সেনাঘাঁটি রয়েছে তুর্কিদের। তুরস্ক আছে সিরিয়ায়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝখানে নিজস্ব ওজন নিয়ে। সিরিয়ার ভাগ্যের তাস শুধু রাশিয়া নয়, তুরস্কের হাতেও ধরা। রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রকে ‍সিরিয়া নিয়েও তুরস্কের সঙ্গে লেনদেন করতে হবে। তুরস্ক আছে লিবিয়ায়, রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের বাহিনী যে রাজধানী ত্রিপোলি দখল করতে পারেনি, আমেরিকা ও তার মিত্রদের সেই কৃতিত্ব অবশ্যই এরদোয়ানকে দিতে হবে।

তুরস্কের সেনাঘাঁটি রয়েছে কাতারে, সোমালিয়ায়, উত্তর সাইপ্রাসে। উত্তর সাইপ্রাসের তুর্কি বংশোদ্ভূত নতুন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনুগত। ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাসভান্ডারের ওপর গ্রিসের দাবি নস্যাৎ করতে সেখানে অবস্থান করছে তুর্কি যুদ্ধজাহাজের বহর।

সাম্রাজ্যের জন্য সেনাবাহিনী, সংস্কৃতির জোর এবং কূটনৈতিক জাল ছড়ানো খুবই কাজের। কিন্তু প্রবল সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে দরকার শক্তিশালী অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা। দুই জায়গাতেই তুরস্ক এখন খুবই দুর্বল। এরদোয়ানের নেতৃত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে কি তিনি ভেতরের দুর্বলতা বাইরের জুয়ার জয় দিয়ে ঢাকতে চাইছেন? হয়তো তা-ই।

একসঙ্গে এতগুলো ফ্রন্ট খুলে কী হাসিল করতে চাইছেন এরদোয়ান? সাদাচোখে তাঁর আচরণ মনে হবে স্ববিরোধী। আমেরিকার শাসানি উপেক্ষা করে ট্রাম্প আমলে তিনি রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনলেন। আবার ব্রাসেলসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর ওই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চালু না করার শর্তে নিজ দেশে মিগ যুদ্ধবিমান বানানোর অনুমতিসহ আরও সুবিধা আদায় করলেন। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, রাশিয়ার সব কটি ফ্রন্টে (ইউক্রেন থেকে আজারবাইজান, লিবিয়া থেকে সিরিয়া) নাক গলিয়ে ন্যাটো তথা আমেরিকার হয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে চলমান বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ন্যাটো সামরিক মহড়ায় তুরস্কও আছে মিত্র বেশে।
তাহলে প্রশ্ন আসে, পুতিন কি এতটা সহ্য করবেন? নাকি ২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থান থেকে রুশ গোয়েন্দা-সাহায্যে রক্ষা পাওয়া এরদোয়ান ‘ডাবল গেম’ খেলছেন? ন্যাটো-মিত্র হয়ে তিনি পশ্চিমাদের কাছ থেকে সুরক্ষা আদায় করছেন, আবার মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পরিকল্পনা ভন্ডুল করার কাজ করে রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণও হয়ে উঠছেন।

মনে হবে এরদোয়ান সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চাইছেন। গত এক দশকে তুরস্ক বিশ্বের সব দেশে তাদের দূতাবাসের সংখ্যা অনেক বাড়িয়েছে। তুর্কি গোয়েন্দারা বৈশ্বিকভাবে অনেক দেশেই অত্যন্ত সক্রিয়। তুর্কি কোমলাস্ত্র হলো তাদের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান, আরব থেকে আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপে তুর্কি কাহিনি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সাম্রাজ্যের জন্য সেনাবাহিনী, সংস্কৃতির জোর এবং কূটনৈতিক জাল ছড়ানো খুবই কাজের। কিন্তু প্রবল সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে দরকার শক্তিশালী অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা। দুই জায়গাতেই তুরস্ক এখন খুবই দুর্বল। এরদোয়ানের নেতৃত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে কি তিনি ভেতরের দুর্বলতা বাইরের জুয়ার জয় দিয়ে ঢাকতে চাইছেন? হয়তো তা-ই। মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপে প্রভাববলয় তৈরি করার যে বাজিতে তিনি নেমেছেন, তা হয়তো পুরোটাই জুয়া নয়। তা হিসাব-নিকাশ করা চাল।

মানচিত্র দেখলে বোঝা যায় কার সঙ্গে কার যুদ্ধ হবে। যুক্তরাষ্ট্র আর তুরস্ক এতই দূরের দেশে, যার যার মাটিতে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। যেমন কথা নয় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যেও। জাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে হুংকার এক জিনিস, আর বাস্তবতা আরেক জিনিস।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের যুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। তুরস্কের একদিকে চীন, আরেকদিকে রাশিয়া। চীনকে অর্থনৈতিক মিত্র বানিয়ে নিয়েছে তুরস্ক। চীনের সঙ্গে তার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অতীতেও ছিল না, এখনো নেই। উইঘুর মুসলমানরা তুর্কি সুলতানের মাথাব্যথা নয়। তুরস্কের মাথাব্যথা আসলে তার সীমান্ত ঘিরে বাড়তে থাকা রুশ প্রভাব। সম্ভবত, আখেরি শত্রুর সঙ্গে দর-কষাকষিই তুরস্কের লক্ষ্য। সে জন্যই ন্যাটোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিংবা কোথাও কোথাও নিষ্ক্রিয় রেখে তুরস্ক রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, যাতে পুতিন নিজস্ব বলয়ে তুরস্কের অধিকার মেনে নেন। বিষয়টা অনেকটা দামি যৌতুক দিয়ে অহংকারী নারীকে স্ত্রী করে নেওয়ার মতো। তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় চাইছে নর্ড স্ট্রিম নামক পাইপলাইনে, সমর্থন চাইছে ভূমধ্যসাগরের গ্যাসভান্ডার নিয়ে তার দাবি প্রতিষ্ঠায়।

এত সব নিয়ে এরদোয়ান হয়ে দাঁড়িয়েছেন সবচেয়ে অনুমান-অযোগ্য নেতা। তিনি কী করবেন, তা আগাম ভাবা কঠিন। আজারবাইজানের যুদ্ধে তিনি পশ্চিমাদের হুঁশিয়ারি শোনেননি, রাশিয়ার স্বার্থকেও মানেননি। বরং সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত ককেশাস অঞ্চল আজারবাইজানেও সামরিক খুঁটি গড়েছেন। ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভালো নয়। অথচ কিনা পশ্চিমাদের মিত্র মিসরের জেনারেল সিসিও এরদোয়ানের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে চাইছেন। এরদোয়ানও হয়তো মানছেন যে তাঁর রাজনৈতিক বন্ধু ইসলামিক ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট মুরসি বিগত, জেনারেল সিসিই বর্তমান। সিসির সঙ্গে আলোচনা চলা অবস্থায় তুরস্ক নীল নদের ওপর বাঁধ বিষয়ে মিসর আর ইথিওপিয়ার দ্বন্দ্বে ইথিওপিয়ার পক্ষ নিয়েছে।

পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তুর্কি খলিফা কেবল খেলাফতই হারাননি, সাম্রাজ্যই হারিয়েছেন। এরদোয়ানের যাবতীয় সাফল্যের পরেও আশঙ্কাটা থেকেই যায়, ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে ডাবল গেম খেলতে গিয়ে তিনি কি তুরস্কের নতুন ইতিহাস রচনা করছেন? নাকি আবার ঘটাতে চলেছেন শেষ অটোমান সম্রাটের ভুলের পুনরাভিনয়?

কৌশলটা অনেকটা চীনের মতো। চীন যেমন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গেও আছে, আবার বিদ্রোহীদের মদদ দিয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের জরুরত বন্ধুকে বুঝিয়েও দিয়েছে। এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে, সিরিয়ার আসাদ ও বিদ্রোহীদের মধ্যে, মিসর আর ইথিওপিয়ার মধ্যে, আফগান সরকার + ন্যাটো বনাম তালেবানের মধ্যে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে নিজেকে সেভাবেই স্থাপন করে নিয়েছে। তুর্কি ভূরাজনৈতিক অবকাঠামো এত জায়গায় ছড়ানো যে সব আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তির তাকে দরকার হবে। নিজেকে সবার খেলায় এতটাই জড়িয়েছেন যে চাইলেও তাঁকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তাঁর কঠিন ভাষা, কূটচাল সত্ত্বেও তাঁকে সবারই দরকার। নিজের এই গরিমা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টকে পেছনের আসনে বসতে বাধ্য করে।

গোড়ার কথায় আসা যাক। সুলতান সেলিম আরব-আফ্রিকা-ইউরোপজুড়ে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন। তাঁর কাছে সব বাণিজ্যপথ হারিয়ে ফেলা ইউরোপ তখন বাধ্য হয়েছে এশিয়া ও আমেরিকার নতুন নৌপথ আবিষ্কারে। ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে সেলিমের যুদ্ধের ফলে দুর্বল পোপতন্ত্র মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন জয়ী হয়। সে সময়ের বিশ্বের আলোকিত রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে জ্ঞান ও প্রযুক্তি ইউরোপে আসতে পারে। আরও অনেক কারণের সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁয় সেলিমেরও অবদান কম নয়। ইউরোপ কফি খাওয়ার অভ্যাস তুর্কিদের কাছ থেকেই পায়, পায় উইন্ডমিল থেকে শুরু করে নৌবিদ্যার অনেক জ্ঞান। সেলিমের তাড়া খেয়ে ইউরোপীয় বণিক ও রাজাদের আফ্রিকা ও আমেরিকা ছাড়া উপনিবেশ গড়ার আর কোনো জায়গা খালি ছিল না।

এরদোয়ান নিজেকে সেই স্তরে ভাবতে চাইছেন। তিনি বদলে দিতে চাইছেন বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তির মধ্যকার ভারসাম্য। এরদোয়ান যে পক্ষে থাকবেন, সেই পক্ষের জয়ের সম্ভাবনা ব্যাপক। বিশ্বকে চীন-রাশিয়া মিলে নতুনভাবে পরিচালনা করা এবং ভাগবাঁটোয়ারার যে নতুন পর্ব শুরু হয়েছে, উচ্চাভিলাষী এরদোয়ান সেখানে নিজেকে দর-কষাকষির জায়গায় এনে তুরস্ককে ছোট তরফের অংশীদার বানাতে চাইছেন।
এই কাজে এ পর্যন্ত এরদোয়ান সফল বটে; তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমীকরণটা মনে রাখা দরকার। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তুর্কি খলিফা কেবল খেলাফতই হারাননি, সাম্রাজ্যই হারিয়েছেন। এরদোয়ানের যাবতীয় সাফল্যের পরেও আশঙ্কাটা থেকেই যায়, ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে ডাবল গেম খেলতে গিয়ে তিনি কি তুরস্কের নতুন ইতিহাস রচনা করছেন? নাকি আবার ঘটাতে চলেছেন শেষ অটোমান সম্রাটের ভুলের পুনরাভিনয়? সে সময় পতনমুখী ছিল জার্মানি ও তার মিত্ররা। এখন পতনমুখী আমেরিকা ও তার মিত্ররা। উদিত চীন আর প্রত্যাবর্তিত রাশিয়া যদি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, তুরস্ক কি দ্বিচারীপনা ছেড়ে কোনো এক পক্ষে সম্পূর্ণ হেলে পড়বে? ন্যাটো না রাশিয়া? দুদিকেই তুরস্কের পথ বানানো আছে, চূড়ান্ত বাছাই দেখার জন্য হয়তো আমাদের সংঘাত চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তবে কীভাবে প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে আসতে হয়, এরদোয়ানের রাজনীতি তার এক চলমান শিক্ষাসফর।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]