এস এম নূরুল হুদা

শহীদ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শরীয়তপুর, ঢাকা

এস এম নূরুল হুদা

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন।


বরিশাল বিএম (ব্রজ মোহন) কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এস এম নূরুল হুদা।

শিক্ষাব্রতী হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। ১৯৭০ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে এমফিল করার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। একাত্তরের প্রথমার্ধ ছিল তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মধ্যপর্যায়।

কিন্তু এ সময় দেশে শুরু হয় আন্দোলন। তখন তিনি দেশে ফিরে আসাকেই সুবিবেচনার কাজ বলে মনে করেছিলেন।

শুধু দেশের প্রয়োজনে লন্ডনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি।

১৫ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তাঁকে বরিশাল থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।


এ সম্পর্কে জানা যায় তাঁর ছেলে এস এম মাহবুব আলমের ‘আমার বাবা’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার বাবা অধ্যাপক এস এম নূরুল হুদা বরিশাল বিএম কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং ইন্টারমিডিয়েট (মুসলিম) হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন।

১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান। একাত্তরের প্রথমার্থে ফিরে আসেন।


‘২৬ মার্চ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম মানচিত্রের জন্য শুরু হলো সংগ্রাম। আত্মসচেতন সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে।

বরিশাল বিএম কলেজের ইউটিসি ইউনিট প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ইন্টারমিডিয়েট হোস্টেলে তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে।

বাবা তাদের এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গঠনে সহায়তা করে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।


‘২৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী বরিশাল দখল করে। পরে সেনারা ওই হোস্টেলে একটি ক্যাম্প স্থাপন করতে চায়।

বাবা কৌশলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে বাবা প্রতিরোধযোদ্ধাদের ওই হোস্টেল ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন, এ কথা পাকিস্তান সেনাবাহিনী জেনে যায়।

পাকিস্তানি সমর্থকেরা এটা সেনাবাহিনীকে জানায়। এর ফলে তিনি তাদের বিরাগভাজন হন।

সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন বাবার ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সাহেবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে বাবাকে সংশোধন হয়ে যাবার কথা বলে এবং জানায় অন্যথায় তারা নিজেরাই বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে।

‘তারপর এল ১৫ জুলাই। এ দিনটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। দিনটি ভোলার নয়।

বাবা মায়ের কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়ে চোখের ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। সেদিন বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়াতে বাবা ছাতা নিয়ে বের হয়েছিলেন।

কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে গেলে বাবা বাসায় ফিরে ছাতা, ঘড়ি, চশমা রেখে আবার ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বেরিয়ে যান।

যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখিয়েই ফিরে আসবেন। তারপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এল, কিন্তু বাবা সেই যে গেলেন, আর এলেন না।

তাঁর যাবার মতো সম্ভাব্য সব জায়গাই খোঁজ নেওয়া হলো, কিন্তু কোথাও তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল না, পাওয়া যায়নি।


‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বরিশাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ডা. আমিনুল ইসলাম আমাদের জানিয়েছিলেন, মেডিকেল কলেজের বিপরীত দিকে ওয়াপদায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বরিশাল সদর দপ্তর ও ক্যাম্প।

একাত্তরের ১৬ জুলাই ওই ক্যাম্পে সেনাদের চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সেখানে তিনি কয়েকটি লাশ দেখতে পান, যাদের আগের রাতে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। লাশগুলোর মধ্যে তিনি আমার বাবার লাশও দেখতে পান।

তাঁর ভাষায়, “ওই লাশগুলোর মধ্যে বিএম কলেজের অধ্যাপক নূরুল হুদার লাশও ছিল।” ডা. আমিনুল ইসলামের কাছেই বাবার শহীদ হওয়ার খবর নিশ্চিতভাবে আমরা জানতে পারি।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, অষ্টম খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯৫, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।


এস এম নূরুল হুদার জন্ম শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা থানার ডামুড্যা গ্রামে, ১৯৩০ সালের ৩১ জুলাই। বাবা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন হাওলাদার।

তিনি ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৪৮ সালে আইএ ও ১৯৫১ সালে স্নাতক পাস করেন। ১৯৫২ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

তখন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তিনি।
এস এম নূরুল হুদার কর্মজীবন শুরু হয় শরীয়তপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে।

১৯৫৭ সাল থেকে কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রথমে দিনাজপুর সুরেন্দ্র নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন।

পরে বরিশাল বিএম কলেজে যোগ দেন। এস এম নূরুল হুদা দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।


প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]