ও গঙ্গা, তুমি বইছ কেন

গঙ্গাপাড়ে মাটিচাপা দেওয়া মৃতদেহের এমন সারিই প্রকাশ করে ভারতে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা। প্রয়াগরাজের কাছে এক এলাকায়, ২১ মে।
ছবি: রয়টার্স

গঙ্গায় ভেসে আসছে লাশ। নদীর পাড়ে লাশের সারি। বাতাসে লাশের গন্ধ। কুকুর আর কাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে মানুষের মরদেহ। উড়ে এসেছে শকুনও। গত মে মাসে ভারতে করোনা মহামারির এমন ভয়াবহতা গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়। ভারতীয় পুরাণে যে গঙ্গা পবিত্র ও শুদ্ধতার প্রতীক, সেই গঙ্গাই হয়ে ওঠে লাশের নদী। যে জলধারায় স্নান করে পুণ্য অর্জন করে সনাতনধর্মী মানুষ, সেটি হয়ে পড়ে দূষিত। ভোরের সূর্যপ্রণামের মধ্য দিয়ে গঙ্গাস্নান শেষে যে মানুষ আজীবন তার দিন শুরু করে গেছে, গঙ্গার ঘাটে বসে সে-ই হয়তো চোখের পানি ঝরিয়েছে।

করোনায় ভারতে সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গেল। আদতে কত মানুষ দেশটিতে করোনায় মারা গেল সেই প্রশ্ন উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসিতে ভারতীয় সাংবাদিক রুমকিনি এস বলছেন, করোনা মোকাবিলায় সফলতার চিত্র তুলে ধরতে মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানোর জন্য শুরু থেকে ‘মিথ্যার আশ্রয়’ নিয়েছে বিজেপি সরকার। সেই কৌশলে সরকারি পরিসংখ্যানে আটকে যায় এপ্রিল-মে মাসে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় মৃত্যুর ভয়াবহতা। সেসময় মধ্যপ্রদেশে সব ধরনের মৃত্যুর মোট হার স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচগুণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত এই মৃত্যুহার ছিল করোনায় মৃত্যুর সরকারি হিসাবের চল্লিশ গুণ। একইভাবে উত্তর প্রদেশ, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশেও করোনায় মৃত্যুর হার কম দেখানো হয়েছে। রুমকিনির মতো ভারতের অনেক সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞই স্পষ্ট উচ্চারণে করোনা নিয়ে দেশটির সরকারের ‘মিথ্যাচারের’ বিষয়টি তুলে ধরছেন। পবিত্র গঙ্গার পাড়জুড়ে কান্নার আহাজারিও কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয়।

উত্তরাখন্ডের হরিদ্বার হয়ে এঁকেবেঁকে উত্তর প্রদেশের প্রায় পেট চিরে ওপর থেকে নিচে বিহারে প্রবেশ করেছে গঙ্গা নদী। বিহারের দিকে এসে মির্জাপুরকে মাঝখানে রেখে প্রয়াগরাজ আর বারানসি। হিন্দুপুরাণ-বিজড়িত প্রাগৈতিহাসিক শহর এগুলো। হরিদ্বার ও প্রয়াগে ১২ বছর পরপর বসে লাখ লাখ মানুষ নিয়ে পূর্ণকুম্ভ। হিন্দুশাস্ত্রমতে, হরিদ্বারেই দেবী গঙ্গা পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। মানে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এসেছিল গঙ্গা নদী, তাই মর্ত্য থেকে স্বর্গে উত্তরণের একটি মাধ্যমও এটি। প্রতিটি জেলায় গঙ্গার পাড়ে অসংখ্য ঘাট আর শ্মশান। শেষ বয়সে অনেক হিন্দু নারী-পুরুষ এসব শহরে এসে ঠাঁই নেন। গঙ্গার পাড়ে পুণ্যের মৃত্যুই থাকে তাঁদের শেষ ইচ্ছা। তার মধ্যে কাশী ও গয়া হচ্ছে বাঙালি সাহিত্যানুরাগীদের কাছে সুপরিচিত দুই তীর্থস্থান। কাশীর আরেক নাম বারানসি। এটি উত্তর প্রদেশে। গয়া হচ্ছে বিহারে, তবে সেটি গঙ্গা নয়, ফল্গু নদীর পাড়ে। তো, এ দুই রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে দিল করোনা মহামারি। কারণ, গঙ্গার ঘাটে ঘাটে যে লাশ ভেসে এল, তার দায়ভার কেউ নিতে চাইল না।

প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আগেভাগেই করোনার টিকা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল বিজেপি সরকারের, যেহেতু দেশেই উৎপাদিত হচ্ছিল টিকা। কিন্তু মোদি ব্যস্ত হয়ে গেলেন চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আঞ্চলিক টিকাকূটনীতি নিয়ে। আর ভারত নিজেই পড়ে গেল টিকাসংকটে। এর মধ্যে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি ছাপিয়ে গেল গঙ্গার ঢেউ।

কাশী বললেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার বাবা হরিহরের মৃত্যু চোখে ভেসে ওঠে। গঙ্গার ঘাটেই তাকে পোড়ানো হয়েছিল। সেই ঘাটে কিনা হলো চিতা জ্বালানোর কাঠের অভাব। করোনার মড়া পোড়াতেও কেউ রাজি হলো না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এক ঘাটের প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, একটা মড়া পোড়ানোর খরচ দাঁড়াল ১০ হাজার রুপি, আগে যেটি ছিল এক থেকে দুই হাজার। ঘাটে ঘাটে অসংখ্য মানুষ স্বজনের লাশ নিয়ে বসে ছিল। পোড়ানোর সামর্থ্য নেই, শেষমেশ নদীর পাড়ে বালুর নিচে লাশ চাপা দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে মানুষ। কেউ হয়তো সুনীলের ‘সেই সময়’-এর থাকোমণির মতো কোলে মৃত বাচ্চা নিয়ে পাথর হয়ে বসেও ছিল। কলেরা তাকে নিয়ে এসেছিল কাশীরই গঙ্গার ঘাটে। পরে যখন কারও ডাকে হুঁশ হয়, কেঁদে ওঠে থাকোমণি। গঙ্গায় ভাসিয়েও দেয় মরা বাচ্চাকে। শত বছর পরে আরেক মহামারিতেও এভাবে মানুষ লাশ ভাসিয়ে দিল গঙ্গায়। কারণ, শিশু, অবিবাহিত মেয়ে, সংক্রামক ব্যাধি ও সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে নদীতেই লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি এখনো চালু আছে গঙ্গার তীরবর্তী অনেক এলাকায়। অন্যদিকে, এনডিটিভি জানাল, হাসপাতালে মর্গ উপচে পড়ায়, শহরের চিতা ও কবরস্থানে জায়গা না হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা গঙ্গায় লাশ ছুড়ে ফেলেন। সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। হিন্দি দৈনিক ভাস্কর জানাল, বৃষ্টিতে ও জোয়ারের পানিতে বালু ও মাটি সরে গিয়ে পাড়ের লাশও চলে এসেছিল নদীতে।

মে মাসের শুরু থেকে গঙ্গায় লাশের দেখা মিলছিল। মানুষের অভিযোগ কানে তোলেনি প্রশাসন। এরপর এনডিটিভি জানাল, ১০ মে বিহারে বক্সারে জেলায় গঙ্গায় ভেসে আসে সত্তরের বেশি লাশ। পরদিন পাশের রাজ্য উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলায় ভেসে আসে আরও কয়েক ডজন পচা-গলা লাশ। দুই রাজ্যের পার্শ্ববর্তী দুই জেলা নিয়ে হইচই পড়ে গেল গোটা ভারত। বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনাম হলো পবিত্র গঙ্গা। এপ্রিল মাসজুড়ে ভারতের মহামারির করাল গ্রাস দেখল গোটা বিশ্ব। সে মাসেই কিন্তু ঘটল হরিদ্বারে ১০ লাখ মানুষ নিয়ে কুম্ভমেলা। পরে তো কুম্ভে প্রায় এক লাখ ভুয়া করোনা টেস্টের সার্টিফিকেট দেওয়ার খবর বেরিয়ে এল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, তখন পর্যন্ত ভারতের মোট করোনায় মৃত্যুর ২০ শতাংশই ঘটেছে এপ্রিলে, যা ৪০ হাজারের কাছাকাছি।

এ হচ্ছে সরকারি পরিসংখ্যান, মানে শুধু হাসপাতালে মৃত্যুর হিসাব। কিন্তু দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের সব শহরে হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেনের জন্য যে আহাজারি, লাশ সৎকার বা দাফনের জায়গা ও কাঠের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছিল, তাতেই বোঝা যাচ্ছিল হাসপাতালের বাইরেও কত মানুষকে কেড়ে নিয়েছে মহামারি। বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, সরকারি হিসাবের চেয়েও বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো দাবিই করে বসল, বিজেপি সরকার করোনায় মৃত মানুষের লাশ গোপন করছে। সেই দাবিকেই যেন চোখের সামনে হাজির করে দিল গঙ্গা। সবার নজর শহরগুলোর দিকে থাকলেও গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কী পরিস্থিতি, সেটি কেউ তলিয়ে দেখেনি। মে মাসে দ্য ইকোনমিস্ট জানাল, সেই সময় পর্যন্ত ভারতে করোনায় ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়ে থাকতে পারেন, যা সরকারি হিসাব থেকে তিন গুণ বেশি। এখন অবশ্যই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের।

উত্তরপ্রদেশে গঙ্গাপাড়ে কবরের সারি। জোয়ার বা বৃষ্টিতে মাটি–বালি সরে গিয়ে লাশ চলে আসছে নদীতে।
ছবি: রয়টার্স

উত্তর প্রদেশের গঙ্গাতীরবর্তী ২৭টি জেলায় নদীর পাড় হয়ে ওঠে এক মৃত্যু-উপত্যকা। রয়টার্সের ছবিতে দেখা গেল সে দৃশ্য। বিজনোর, মেরঠ, মুজফফরনগর, বুলন্দ শহর, হাপুর, আলিগড়, বদায়ুঁ, শাহজাহানপুর, কনৌজ, কানপুর, উন্নাও, রায়বরেলি, ফতেপুর, প্রয়াগরাজ, প্রতাপগড়, মির্জাপুর, বরানসি, গাজিপুর, বালিয়া প্রভৃতি জেলা ও শহরে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে মিলল লাশ। নদী থেকে লাশ তুলে শেষ করা যাচ্ছিল না। মে মাসে বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানাল, সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত চলল এই লাশ উত্তোলন। কনৌজের মহাদেবী গঙ্গাঘাটের কাছে সাড়ে তিন শতাধিক, কানপুরের শেরেশ্বর ঘাটের কাছে চার শতাধিক, উন্নাওয়ে শুক্লাগঞ্জ ও বক্সার ঘাটের কাছে নয় শতাধিক, গাজিপুরের বিভিন্ন ঘাটের কাছে তিন শতাধিক মৃতদেহ পাওয়া যায়। কুকুর ও শিয়ালে অনেক মৃতদেহ টেনে বের করে নিয়ে এসেছে। শকুন উড়ে এসে বসেছে। জুন মাসের শেষের দিকে রয়টার্স জানাল, সে মাসেও প্রয়াগরাজে গঙ্গায় ভেসে আসা শতাধিক লাশ তোলা হয়। যাদের মধ্য ছিল কেউ সার্জিকাল গ্লোভস পরিহিত, আবার কারও মুখে অক্সিজেন টিউব লাগানো। কল্পনা করা যায় সে দৃশ্য!

হিমালয় থেকে আসা ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীর সংগমস্থল উত্তরাখন্ড থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়া পর্যন্ত গঙ্গার মোট দৈর্ঘ্য ধরা হয় ২ হাজার ৫২৫ কিলোমিটার। আর এ লাশের সারি দেখা গেছে গঙ্গার ১ হাজার ১৪০ কিলোমিটারজুড়ে। এ থেকেই ধারণা করা যায়, মৃত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা কেমন হতে পারে। অথচ জানুয়ারিতেই করোনাকে জয় করে ফেলার ঘোষণা দিয়ে কয়েকটি রাজ্যের মানুষকে নির্বাচনের জোয়ারে নামিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। করোনায় মৃত মানুষের এ গঙ্গাযাত্রায় সেই মোদির কোনো আওয়াজ ছিল না। বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বললেন, হাসপাতালের শয্যা ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো ‘গায়েব’ প্রধানমন্ত্রী মোদিও। আউটলুক প্রচ্ছদ করল, ‘মিসিং, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’, তাঁর খোঁজ পেলে ভারতের নাগরিকদের জানান। অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনে গঙ্গাপাড়ের বারানসি আসন থেকে নির্বাচনে জিতে জনগণের ‘প্রধান সেবক’ ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন মোদি। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আগেভাগেই করোনার টিকা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল বিজেপি সরকারের, যেহেতু দেশেই উৎপাদিত হচ্ছিল টিকা। কিন্তু মোদি ব্যস্ত হয়ে গেলেন চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আঞ্চলিক টিকাকূটনীতি নিয়ে। আর ভারত নিজেই পড়ে গেল টিকাসংকটে। এর মধ্যে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি ছাপিয়ে গেল গঙ্গার ঢেউ। যদিও এখন সংক্রমণের হার কমে এসেছে ভারতে।

ভূপেন হাজারিকা শেষ বয়সে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। উত্তরাখন্ড থেকে বিহার পর্যন্ত সুদীর্ঘ গঙ্গার পারে পারে তবু তাঁর গাওয়া গানটার কথাই সত্য হয়ে উঠল—‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও...ও গঙ্গা, তুমি বইছ কেন?’ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ বারানসিতেই গঙ্গায় নৌকাতে বসে সানাই বাজিয়েছেন। মহামারির সে দুঃস্বপ্নকাল কেটে গেলেও শোকের প্রতীক হয়ে বিসমিল্লাহর সেই সানাইয়ের করুণ সুরই কি গঙ্গার বুকে বাজছে না আজও?

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক।