ওই ধর্ষকদের আত্মা কী দিয়ে তৈরি?

বনজঙ্গলে পাশবিক তাড়নায় মাতাল হয়ে জৈবিক ক্রিয়া সারার পর পশুর কোনো বিকার থাকে না। তাদের বেলায় প্রেম ও নির্যাতন কোনো অর্থই বহন করে না। কিন্তু মানুষ শুধু প্রাণী নয়, বিবেকসম্পন্ন সামাজিক জীব। তারপরও নরপশুরা তাদের শিকারের ওপর চড়াও হয়। তাদের ভোগলিপ্সার মধ্যে হননেচ্ছাও ছিল।

গত শুক্রবার রাতে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে চলন্ত বাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা আমাদের আবারও এই আদিম বাস্তবতার মধ্যে ফেলে দিল? যা থেকে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র আমাদের নারীদের সব সময় রক্ষা করতে পারে না, মধুপুর জঙ্গলের ঘটনায় সেটাই দেখা গেল।

ধর্ষণের অভিযোগে গত সোমবার রাতে পাঁচ পরিবহনশ্রমিককে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের মধ্যে কোনো বিকার ছিল না। ধর্ষণ ও হত্যার মতো এত বড় একটা অপরাধ ঘটানোর পরও তারা নির্বিকারভাবে রোজকার কাজ করে যাচ্ছিল। গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। ভাবগতিক এমন, যতই আইনি প্যাঁচ খাটাও—কচুটা হবে!

২০১২ সালের ডিসেম্বরে ভারতের দিল্লিতে নির্ভয়া (ছদ্মনাম) বলে এক ফিজিওথেরাপির ছাত্রী চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আমাদের দেশে এমন ঘটনা কয়েকবারই ঘটেছে। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাসচালক ও সহকারীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। এরপর নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একই ঘটনা বারবার ঘটনার পরও বাসে নারীর কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোরালো উদ্যোগ নেই। না পরিবহন–সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ, না বাস মালিকেরা—এদিকে সেভাবে নজর দেওয়ার কেউ নেই। বিষয়টি যেন ডালভাত। আর কিছু পরিবহনশ্রমিকের মানসিকতাই বা এমন হবে কেন, কোনো নারীকে একা পেলেই মা-বোনের মতো না দেখে ভোগের পণ্য হিসেবে দেখবে। তাৎক্ষণিকভাবে ভোগ করার দুর্দম ইচ্ছা জাগবে? এ ক্ষেত্রে আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে বলেই তারা এমস দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পায়। পরিবহনশ্রমিকেরা কোনো ঘটনায় জড়িত হলে বা অপরাধমূলক কিছু করলে অনেক ক্ষেত্রে পেছন থেকে মালিকপক্ষ বা শ্রমিক সংগঠন ত্রাতার ভূমিকায় থাকে। এটাও তাদের মন্দ কাজে আশকারা দেয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চলন্ত বাসের কিছু ধর্ষকামী ছুঁচোর মতো মুখিয়ে আছে—বাসে কাউকে একলা পেলেই হয়! তাদের আত্মা কেমন? কলিজা, গুর্দা, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস—অন্য সব সাধারণ মানুষের মতো, নাকি এর মধ্যে আলাদা কোনো বিশেষত্ব আছে, যা দেখে একটা হিংস্র প্রাণীও লজ্জা পাবে?

ধর্ষণ এমন একটি ঘটনা, যে ক্ষত বেশির ভাগ নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফির আসতে যত সমর্থনই দেওয়া হোক না কেন, ভেতরে তাঁর ক্ষরণ রক্তঝরা কাটা দাগের মতো থাকে। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে চলার মতো নারী যে নেই, তা বলব না। তবে এমন ঘটনা বিরল। যত দিন সমাজের চোখ তাঁকে হেয় করবে, তত দিন নির্যাতিত নারীকে এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে সংগ্রাম করে যেতে হয়।

চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার রূপার কথা ভাবলে চক্ষু আঁধার হয়ে আসে। হৃদয় ফালি ফালি হয় বেদনার আঁচড়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভয়ংকর সেই ‘ভিখু’ এই ধর্ষকদের কাছে নস্যি।

ঘটনাটি ঘটার আগে চলন্ত বাসটির দিকে তাকালে কী দেখি? এটি তখন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল বা অ্যানিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলের কোনো বুনো প্রান্তর। যেখানে অসহায় এক হরিণকে ঘিরে ধরেছে পাঁচ-পাঁচটি হায়েনা। রক্ত আর মাংসের গন্ধে লল্লড় করছে ওদের লোলুপ জিব। বেরিয়ে পড়েছে ছেদক শ্বদন্ত।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ওই ঘটনার আগে তরুণী রূপা তাঁর সঙ্গে থাকা পাঁচ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন স্বেচ্ছায় বের করে দিয়েছিলেন। করজোড়ে বলেছিলেন, এসব নাও। তবু আমাকে আক্রমণ কোরো না। দয়া করো!

কিন্তু পাষাণপ্রাচীর পেরিয়ে করুণার আধারে যেতে পারেনি এ মিনতি। তারপর যা ঘটেছে, তা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার মতোই।

মেয়ের মৃত্যুর খবর জানার পর দুর্ভাগা মা বিলাপ করছেন আর বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। অসুখ নয়, বিসুখ নয়, কোনো দুর্যোগের আলামতও নেই, এর মধ্যে আচমকা ‘নেই’ হয়ে গেছে তাঁর ছোট সন্তানটি, যে ছিল অন্য চারজনের অতি আদরের। সিরাজগঞ্জের এক গ্রামে বেড়ে ওঠা যে রূপা অদম্য মনোবল আর বড় হওয়ার দুচোখভরা স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। বগুড়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর করার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। কর্মস্থল শেরপুর। একই সঙ্গে ঢাকা একটি আইন মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরিবার বলছে, তিনি মেধাবী ছিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠার সম্মানজনক আসনে তুলে ধরার চেষ্টা যে তাঁর ছিল, এটা তাঁর ক্যারিয়ারই বলে দেয়। আর তাঁকে ঘিরে মায়ের-ভাই-বোনদেরও যে অনেক আশা আর স্বপ্ন ছিল, এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না।

বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাসে করে ফেরার পথে খুন হন রূপা। বাসে ওঠার আগ মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও কি তিনি ভেবেছিলেন, এটাই তাঁর শেষ যাত্রা? ‘আমি এখনো বাসে আছি, বাসায় পৌঁছে তোমাকে জানাব’—মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে রূপার এটাই শেষ কথা। মা হয়তো মনে মনে দোয়া করছেন, মেয়েটি ভালোয় ভালোয় গন্তব্যে পৌঁছাক। তাঁর চাকরি পাওয়ার আশাটি পূরণ হোক। মমতাময়ী মা ভাবেননি, নয়টি মাস তাঁর গর্ভে সযত্নে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা আদরের ওই নাড়ি ছেঁড়া ধনকে মাংসলোভী হিংস্র কয়েকটি জানোয়ার খুবলে খেয়ে ভাগাড়ের অসহায় প্রাণীর মতো ছুড়ে ফেলবে। এসব জানোয়ারের আত্মা আসলে কী দিয়ে তৈরি?

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক, সাংবাদিক
[email protected]