ওরা স্কুলে নয়, কোচিংয়ে পড়ে

২০-২১ বছর আগের কথা একটু বলি। তখন আমি স্কুলে পড়ি, কিন্তু স্কুলের পড়াটা অভিভাবকদের ঠিক মনঃপূত হতো না বলে আমাকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করানো হয়। তবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করানোর আরও একটা লক্ষ্য ছিল, সেটি হচ্ছে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। ধারণাটা ছিল এ রকম যে কোচিং সেন্টারে প্রতি সপ্তাহে নানা রকম পরীক্ষা নেওয়া হয় বলে ছাত্ররা চাপের মুখে পড়াশোনাটা ভালোভাবে করবে। কিন্তু এখন তো ধন্দে পড়ে যাই, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ে, নাকি কোচিং সেন্টারে পড়ে!
আরও একটি ব্যাপার না বললেই নয়। পড়াশোনাটা যেন এখন আর ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপার নয়, অভিভাবকদের ব্যাপার। এই ঢাকা নগরেই বহু মা আছেন, যাঁদের একমাত্র কাজ হচ্ছে (ঘরের কাজের বাইরে), স্কুলের পর সন্তানকে নিয়ে এই কোচিং সেন্টার থেকে ওই কোচিং সেন্টারে দৌড়ানো। এমনকি সেটা করতে গিয়ে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও তাঁরা থামেন না, তাঁদের যেন থামানোর কেউ নেই। দুর্দমনীয় গতিতে তাঁরা এগিয়েই চলেছেন!
প্রায় চার বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক নীতিমালা প্রণয়ন করে। এতে বলা হয়েছিল, সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে এক দিনে অন্য প্রতিষ্ঠানের সীমিতসংখ্যক (১০ জনের বেশি নয়) শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দিয়েছে, ২০১২ সালের জুনে জারি করা নীতিমালাটি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু আমার তো আশঙ্কা হচ্ছে, কোচিংওয়ালারা নয়, খোদ অভিভাবকেরাই এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে মাঠে নামবেন!
স্কুল-কলেজে পড়াশোনা হয় না, এটা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। আরও ২৫-৩০ বছর আগে থেকেই এমনটা ঘটছে। তখন প্রাইভেট পড়া বা কোচিংয়ে পড়ার একটা সীমা ছিল, সাধারণত বিজ্ঞানের বিষয়, গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝার জন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হতো। কিন্তু গ্রেড পয়েন্ট চালু করার পর দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে শুরু করে। কারণ, জিপিএ-৫ তো হাতছাড়া করা যাবে না। এরপর এল সৃজনশীল। বলা হলো, এখন আর পড়া মুখস্থ করতে হবে না। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। শিক্ষকেরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও চর্চার অভাবে সৃজনশীলটা ভালোভাবে পড়াতে পারছেন না। এতে অভিভাবকদের আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। সে কারণে কোচিং এখন আরও রমরমা হয়ে উঠেছে।
আমরা যেখানে সামাজিক বিজ্ঞান ও ধর্মের মতো বিষয় বাসায় নিজে পড়েই তাতে লেটার মার্ক পেতাম, সেখানে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা এসব বিষয়ের জন্যও প্রাইভেট শিক্ষক বা কোচিংয়ের দ্বারস্থ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আজকের দিনের মা-বাবারাও এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে তাঁরা সন্তানদের পড়াটা ভালোভাবে দেখিয়ে দেওয়ারও সময় পান না বা অনেকে তা করতেও চান না। সে কারণে সহজ রাস্তা হিসেবে তাঁরা সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। এর জন্য প্রচুর ব্যয় হলেও মানুষ সেটা গায়ে লাগাচ্ছে না। মানুষের আয় বেড়েছে, সেটাও ঠিক। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, অভিভাবক হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, আমরা সেটা করছি না। এতে সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়, যার কারণে নানা রকম সামাজিক সমস্যাও হয়। কিন্তু জানা সত্ত্বেও আমরা তা করেই যাচ্ছি।
কথা হচ্ছে, শিক্ষা এখন আর জগৎকে জানা-বোঝার হাতিয়ার নয়, অর্থ কামানোর ব্যাপার। অন্তরকে আলোকিত করার বালাই! আর নেই বললেই চলে। কিন্তু স্রেফ ক্যারিয়ারের শিক্ষার জন্যও এভাবে কোচিং সেন্টারে দৌড়ানোর প্রয়োজন আছে কি?
মানুষ গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে পৃথিবীর যেকোনো কাজ করতে পারবে। আর এখন যে জিপিএ-৫-এর বাহার শুরু হয়েছে, তাতে আপনার আমার সন্তান তা না পেয়ে যাবে কোথায়! পাঠকদের নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হকের কথা মনে আছে, যিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁর মেয়ে কীভাবে প্রাথমিক সমাপনীতে জিপিএ-৫ পেল, যেখানে সে প্রথম শ্রেণি থেকে সি পেয়ে আসছে! এই ফোলানো-ফাঁপানো জিপিএ-৫-এর বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছিলেন। সুতরাং, আপনিও নিশ্চিত থাকতে পারেন, মোটামুটি গোছের পরীক্ষা দিলেই আপনার সন্তানও জিপিএ-৫ পেয়ে যাবে। এ কারণে তাকে এত কষ্ট না দিয়ে গণিত ও ভাষাটা ভালোভাবে শেখানো দরকার। সন্তানকে হাসতে দিন, খেলতে দিন, জগৎটা দেখতে দিন। অন্যদিকে ভর্তিতে দুই নম্বরীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। শেষমেশ যদি মনে করেন, শিক্ষার লক্ষ্য আরও বড়, তাহলে সবাইকে মাঠে নামতে হবে।