কংসবধ: কৃষ্ণের ধর্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম প্রয়াস

আমরা জানি দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ অধর্মের বিপরীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মথুরার রাজকন্যা দেবকীর অষ্টম গর্ভে ভাদ্র মাসের রেবতী নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বসুদেব কংসের দ্বারা প্রাণসংশয় হতে পারে আশঙ্কা করে সদ্যোজাত পুত্রকে রাতের অন্ধকারে সেই ঝড়-জলের মধ্যে যমুনার অপর পারে গোকুলে নন্দের গৃহে রেখে এলেন। সদ্য সন্তান হারানো যশোদাও তাঁকে পেয়ে পুত্রবোধে লালন-পালন করতে লাগলেন। সেখানে কৃষ্ণ ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন।

কৃষ্ণ চরিত্রের অলৌকিক নয়, বরং আমি বলি অতিলৌকিক বিষয় হচ্ছে, আশৈশব তিনি অমিত বলশালী ছিলেন। সে সময় ঘোষ নিবাসে নেকড়ের উপদ্রব খুব বেড়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণও নানা বিপদে পড়েছিলেন। তাই নন্দ ও অন্য গোপেরা আগের বাসস্থান ত্যাগ করে অধিকতর নিরাপদ সুখের জায়গা বৃন্দাবনে গিয়ে বসতি স্থাপন করলেন।

মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের কাছে খবর পৌঁছাল, বৃন্দাবনে কৃষ্ণ-বলরাম অতিশয় বলশালী হয়ে উঠেছেন। পুতনা থেকে অরিষ্ট পর্যন্ত কংসের অনুচরদের বধ করেছেন। দেবর্ষি নারদ গিয়ে কংসকে বললেন, কৃষ্ণ-বলরাম বসুদেবের পুত্র। দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত বলে যে কন্যাকে কংস হত্যা করেছিলেন, সে নন্দ-যশোদার কন্যা। বসুদেব সন্তান পরিবর্তন করে কৃষ্ণকে নন্দালয়ে গোপনে রেখে এসেছিলেন। এসব শুনে কংস ভীত ও ক্রুদ্ধ হয়ে বসুদেবকে ভর্ৎসনা করলেন ও হত্যা করতে উদ্যত হলেন।

তিনি বলরাম ও কৃষ্ণকে আনার জন্য অক্রূর নামে একজন যাদবপ্রধানকে বৃন্দাবনে পাঠালেন এবং নিজের বিখ্যাত মল্লদের দিয়ে দুই ভাইকে হত্যার জন্য ধনুর্মুখ নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। বলরাম ও কৃষ্ণ অক্রূরের সঙ্গে সেখানে এসে রঙ্গভূমিতে ঢুকে কংসের শিক্ষিত হাতি কুবলয়াপীড়, লব্ধপ্রতিষ্ঠ মল্ল চাণূর ও মুষ্টিককে হত্যা করলেন। কংস এসব দেখে নন্দকে লোহার শিকলে বেঁধে রাখার এবং বসুদেবকে হত্যার আদেশ দিয়ে কৃষ্ণ-বলরামকে তাড়িয়ে দিতে বললেন। তখন যে মঞ্চে বসে কংস ও অন্যান্য যাদব মল্লযুদ্ধ দেখছিলেন, ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ এক লাফে সেখানে উঠে কংসকে চুল ধরে টেনে মল্লভূমিতে এনে ফেললেন এবং চোখের নিমেষে হত্যা করলেন। পরে বসুদেব-দেবকী প্রমুখ গুরুজনকে যথাবিহিত বন্দনা করে কংসের পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনে বসালেন। নিজে রাজা হলেন না। হরিবংশ ও পুরাণসমূহে এমন কংসবধ-বৃত্তান্ত বলা হয়েছে।

কিন্তু মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধবধ পর্বে কৃষ্ণ নিজের কথা যুধিষ্ঠিরকে বলছেন এভাবে, ‘কিছুদিন গত হলে কংস যাদবদের পরাজিত করে সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। ওই দুরাত্মা বাহুবলে জ্ঞাতিদের পরাজিত করে সর্বাপেক্ষা প্রধান হয়ে উঠল। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়রা মূঢ়মতী কংসের দৌরাত্ম্যে ব্যথিত হয়ে জ্ঞাতিদের ত্যাগ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তখন অক্রূরকে আহুক-কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে জ্ঞাতিদের হিতসাধনে বলভদ্রকে সঙ্গে নিয়ে কংস ও সুনামাকে হত্যা করলাম।’

এতে কৃষ্ণ-বলরামের বৃন্দাবন থেকে মথুরায় নিয়ে আসার কোনো কথা নেই। বরং তারা কংসবধের আগে থেকেই মথুরায় বাস করতেন বলে ধারণা করা যায়। কংসবধে অন্য যাদবগণ প্রকাশ্যে তাঁদের সাহায্য করুন বা না করুন, কংসকে রক্ষায় তাঁরা কেউই এগিয়ে আসেননি, এটা স্পষ্ট। কংস তাঁদের সবার ওপর অত্যাচার করত, এ জন্য বোধ হয় তাঁরা রাম-কৃষ্ণের বলাধিক্য দেখে তাঁদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে কংসবধে তৎপর হয়েছিলেন।

কৃষ্ণ ধর্মপ্রাণ, শৈশব থেকেই ধর্মাত্মা। যাদবদের হিতসাধনে তিনি কংসবধে অগ্রসর হয়েছিলেন। কংসকে হত্যা করে করুণহৃদয় আদর্শ পুরুষ কৃষ্ণ কংসের জন্য বিলাপ করেছিলেন। কংসবধে আমরা দেখি, কৃষ্ণ পরম বলশালী, পরম কার্যাধ্যক্ষ, পরম ন্যায়পরায়ণ, পরম ধর্মাত্মা, পরহিতে ব্রতী এবং পরের জন্য কাতর। এখানে তাঁকে আমরা আদর্শ মানুষ হিসেবে পাই।

কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করে কংসের পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনে বসান। প্রচলিত রীতি ও নীতি এই—যে রাজাকে হত্যা করে, সেই তাঁর রাজ্যভোগী হয়। কংসকে হত্যা করে কৃষ্ণ অনায়াসেই মথুরার সিংহাসনে বসতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করলেন না, কারণ, ধর্মত সিংহাসন উগ্রসেনেরই প্রাপ্য। কংস পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করে রাজা হয়েছিলেন। কৃষ্ণ ধর্মপ্রাণ, শৈশব থেকেই ধর্মাত্মা। যাদবদের হিতসাধনে তিনি কংসবধে অগ্রসর হয়েছিলেন। কংসকে হত্যা করে করুণহৃদয় আদর্শ পুরুষ কৃষ্ণ কংসের জন্য বিলাপ করেছিলেন। কংসবধে আমরা দেখি, কৃষ্ণ পরম বলশালী, পরম কার্যাধ্যক্ষ, পরম ন্যায়পরায়ণ, পরম ধর্মাত্মা, পরহিতে ব্রতী এবং পরের জন্য কাতর। এখানে তাঁকে আমরা আদর্শ মানুষ হিসেবে পাই।

পুরাণে বলা হয়েছে, কংসবধের পর কৃষ্ণ-বলরাম কাশীতে সান্দীপনি মুনির কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য গেলেন। সেখানে চৌষট্টি দিনের মধ্যে অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত হয়ে গুরুদক্ষিণা দিয়ে মথুরায় ফিরে এলেন। কৃষ্ণের শিক্ষা সম্বন্ধে এ ছাড়া পুরাণ ইতিহাসে আর কিছু পাওয়া যায় না। নন্দের গৃহে তাঁর শিক্ষা পাওয়ার প্রসঙ্গ কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। অথচ নন্দ জাতিতে বৈশ্য ছিলেন, বৈশ্যদের বেদে অধিকার ছিল। বৈশ্যের গৃহে তাঁদের কোনো বিদ্যাশিক্ষা না হওয়া বিচিত্র বটে। বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হওয়ার আগেই তিনি নন্দের গৃহ থেকে পুনরায় মথুরায় আনীত হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে মহাভারত থেকে যে কৃষ্ণবাক্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে এমন অনুমানই সংগত যে কংসবধের অনেক আগে থেকেই তিনি মথুরায় বাস করছিলেন এবং মহাভারতের সভা পর্বে শিশুপালের কৃষ্ণ নিন্দায় দেখা যায়, শিশুপাল তাঁকে কংসের অন্নভোজী বলে তিরস্কার করে বলছেন, ‘যস্য চানেন ধর্মজ্ঞ ভুক্তমন্নং বলীয়সঃ।/ স চানেন হতঃ কংস ইত্যেতন্ন মহাদ্ভুতং ॥ (মহাভারত, সভাপর্ব, ৪০ অধ্যায়)

অতএব বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হতে না হতেই কৃষ্ণ মথুরায় আনীত হয়েছিলেন। বৃন্দাবনের গোপীদের সঙ্গে তাঁর কৈশোরলীলা যে উপন্যাসমাত্র, এটা তার অন্যতর প্রমাণ। মথুরাবাসকালেও তাঁর কেমন শিক্ষালাভ হয়েছিল, তার বিশেষ কোনো বিবরণ নেই। কেবল সান্দীপনি মুনির কাছে চৌষট্টি দিন অস্ত্রশিক্ষার কথাই আছে। হয়তো তাঁরা কংসবধের অনেক আগে থেকেই মথুরায় অবস্থান করছিলেন। সান্দীপনি ঋষির কাছে ছাড়াও তিনি সমগ্র বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন এবং নিখিল বেদ-বেদাঙ্গ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আঙ্গিরসবংশীয় ঘোর ঋষির কাছে একাদিক্রমে ১০ বছর বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন বলে ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ আছে।

সে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের উচ্চশিক্ষার উপরিভাগকে তপস্যা বলা হতো। শ্রেষ্ঠ রাজর্ষিরা জীবনের কোনো না কোনো সময়ে তপস্যা করেছিলেন, এমন কথা প্রায়ই পাওয়া যায়। আমরা এখন তপস্যা অর্থে যা বুঝি, বেদের অনেক স্থানেই দেখা যায় তপস্যার প্রকৃত অর্থ তা নয়। আমরা বুঝি তপস্যা অর্থে বনে বসে চোখ বুজে নিশ্বাস বন্ধ করে পানাহার ত্যাগ করে ঈশ্বরের ধ্যান করা। কিন্তু দেবতাদের মধ্যে কেউ কেউ এবং মহাদেবও তপস্যা করেছিলেন, এ-ও কোনো কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায়। শতপথব্রাহ্মণে আছে, স্বয়ং পরব্রহ্ম বহু হওয়ার বাসনায় তপস্যার দ্বারা সৃষ্টি করলেন। এসব জায়গায় তপস্যা অর্থে এ রকমই বুঝতে হয়—চিত্ত সমাহিত করে নিজের শক্তির অনুশীলন ও স্ফুরণ করা।

মহাভারতে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ দশ বছর হিমালয় পর্বতে তপস্যা করেছিলেন। মহাভারতের ঐশিক পর্বে আছে, অশ্বত্থামার ব্রহ্মশিরা অস্ত্রে উত্তরার গর্ভপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে কৃষ্ণ সেই মৃত শিশুকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিজ্ঞা করে অশ্বত্থামাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার তপোবল দেখবে।’ আদর্শ মানুষের আদর্শ শিক্ষাই হবে। ফলও তেমন দেখি। কিন্তু সেই প্রাচীনকালের আদর্শ শিক্ষা কেমন ছিল, তা মহাভারতে বিশদ নেই, এটাই বড় দুঃখের বিষয়।

[বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্রর আলোকে]

নান্টু রায় ট্রাস্টি, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট