কক্সবাজারকে ‘বয়কট’ করলেই কি এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

প্রতিবছর শীতের মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই লাখখানেক পর্যটক আসা-যাওয়া করেন কক্সবাজারে। পর্যটকদের পদভারে মুখর হয় লাবণী থেকে সুগন্ধা হয়ে কলাতলী। কিন্তু ইদানীং পর্যটকদের জিম্মি করে এ খাতের ব্যবসায়ীদের অরাজকতা ও সপরিবার বেড়াতে যাওয়া এক গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় কক্সবাজার নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বয়কট কক্সবাজার’ ডাক দেওয়া হয়েছে। কেন এই আহ্বান? কী সমস্যার কারণে আর কেন আমরা কক্সবাজারে যাব না? ‘বয়কট’ কক্সবাজার কি সমস্যাগুলোর সমাধান দেবে?

চাকরির কারণে ২০১৮-২১ প্রায় চার বছর আমি কক্সবাজারে ছিলাম। যেসব সমস্যার কথা এখন ফলাও করে পত্রিকাগুলোতে আসছে, সেগুলো নতুন কিছু না। সমস্যার ফর্দ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে অনেকটা লম্বা। শীতের মৌসুমে টানা তিন দিনের ছুটি থাকলে কক্সবাজারে পর্যটকদের বন্যা হয়। দেড় লাখের মতো পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও, তিন দিনের ছুটিতে চার থেকে পাঁচ লাখ পর্যটক যান কক্সবাজারে। বিশাল জনসমুদ্রের কারণে সমুদ্রের পাশের ছোট্ট শহরটা পরিণত হয় ঢাকার গুলিস্তানে আর সেটার সুযোগ নেন বিভিন্ন ধরনের গাড়ির চালক থেকে ব্যবসায়ী। সারিবদ্ধ বাসগুলো থেকে নেমে আসা পর্যটকদের দেখে তাঁরা দ্রুত উন্নতির আশার আলো দেখতে পান। তাঁদের আচরণে মনে হয়, আজকেই শেষ সুযোগ, যতটুকু পারেন লুটে নেন!

হয়রানির কথা বলতে গিয়ে প্রথমে বলতে হবে তিন চাকার ব্যাটারিচালিত একটি বাহন সম্পর্কে, যার নাম টমটম। বাস কিংবা প্লেন থেকে নেমে প্রথমেই তাদের সঙ্গে আপনার দেখা হবে। টমটমের চালকদের বয়সের কোনো শুরু নেই আর তাঁদের প্রশিক্ষণ কতটুকু আছে, সেটা ভাবার বিষয়। তাঁরা ৩০ টাকার ভাড়া অনায়াসে ২০০ টাকা চান।

প্রথমবার আসা পর্যটকেরা বোকা হন আর যাঁরা অনেক দিন থেকে কক্সবাজারে আছেন, তাঁরা বিব্রত হন। তাঁদের সঙ্গে দামাদামি করলে অনেক সময় পেতে হয় খারাপ ব্যবহার। কলাতলী মোড়ে ‘হিমছড়ি/ দরিয়ানগর’ বলে ডাকতে থাকা টমটমগুলোতে চলে আরেক সিনেমা। হয়তো আপনি একটি টমটম ঠিক করলেন, আরেকজন এসে আপনাকে জোর করবে তাঁর সঙ্গে যেতে এবং বেশি ভাড়াতে! কেন? কারণ, তিনি সিরিয়ালে আগে আছেন! কক্সবাজার এমন একটি জায়গা, যেখানে যুক্তি নামের বস্তুটি খুবই অপ্রতুল। টমটমের পাশাপাশি আরও দুটি তিন চাকার বাহন আছে, সিএনজি ও রিকশা। সিএনজির ভাড়া টমটমের থেকে সাধারণত বেশি।

দ্বিতীয় হয়রানি হোটেলে উঠতে গিয়ে। কক্সবাজারে বাহারি নামের হোটেল পাবেন, যাদের আছে নিজস্ব তারকামান। এই সব তারকামানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক তারকামানের তুলনা শুধুই বোকামি। ময়লা বিছানা আর নোংরা রুমের ভাড়া ট্যুরিস্ট সিজনে প্রতিদিন কয়েক হাজার টাকা। আর ট্যুরিস্ট সিজনে এই নিম্নমানের হোটেলেও রুম পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কখনো কখনো এসব সস্তা দামের হোটেলের রুমভাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের থেকেও বেশি হয়। আমি একজনকে বলতে শুনেছিলাম, ‘রাত ১১টা পর্যন্ত রুম ভাড়া দেব না। রাত বাড়লে দাম বাড়বে।’ তবে এখানে ব্যবসায়ীদের মনোভাব অনেকটা এ রকম—ঘুরবেন, মজা করবেন আর পকেটের সব টাকা আমাদের দিয়ে যাবেন। খাবার আর ৩০০ টাকায় আলুভর্তা-ভাতের আলোচনা এখানে করব না। কক্সবাজারের বেশির ভাগ ভালো রেস্টুরেন্টে আমার খাওয়া হয়েছে। চার বছর রেস্টুরেন্টে খেয়েছি। এখানে ভালো-খারাপ সব ধরনের খাবারের দোকান আছে।

হোটেলে ব্যাগ রেখে পর্যটকেরা সোজা দৌড় দেন সমুদ্রসৈকতে। সেখানে হয়রানির নাম কিটকট, ফান রাইড আর বিচ ফটোগ্রাফার। শুনেছিলাম, বিচে নীল রঙের কিটকটগুলো পর্যটকদের জন্য ফ্রি। কিন্তু চার বছরে আমার সৌভাগ্য হয়নি ফ্রি কিটকটের দেখা পাওয়ার। শীতের মৌসুমে টানা তিন দিনের ছুটিতে হোটেলে জায়গা না পেয়ে অনেকে রাত যাপন করেন রাস্তায়। আবার অনেকে রাত যাপন করেন সমুদ্রসৈকতে ছাতার নিচে কিটকটে, যা শুরুতে খুব রোমান্টিক মনে হলেও, স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভুল সিদ্ধান্ত মনে হয়। প্রতি রাত ১ হাজার ৫০০ টাকায় একটা কিটকটের সঙ্গে পাওয়া যায় একটি বালিশ, একটি কম্বল আর মশার কামড় ফ্রি। আশপাশে অপরিচিত মানুষের আনাগোনা, ছোট ছোট শিশুদের একটু পরপর, ‘স্যার, ম্যাসাজ লাগবে? স্যার, একটা গান শুনবেন? স্যার, পাঁচটা টাকা দেবেন? স্যার, ঝিনুক কিনবেন?’ একটা সময় আর রোমান্টিক মনে হয় না। তার ওপরে আছে এই সব শিশুর দ্বারা হয়রানি। ম্যাসাজের নামে আপনার মাথায় হাত দিয়েছে তো এইবার আপনার বড় নোট দিতে হবে। সৈকতে বিচ ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে পর্যটকদের বাগ্‌বিতণ্ডা নিয়মিত ব্যাপার।

সৈকত আর হোটেলপর্ব শেষে অনেকে ছোটেন মূল শহরের দিকে, উদ্দেশ্য, বন্ধু আর আত্মীয়দের জন্য বার্মিজ মার্কেট থেকে কিছু গিফট কেনা অথবা পানবাজার থেকে শুঁটকি কেনা। এই বেচারারা আটকা পড়েন যানজটে। কক্সবাজার শহরের রাস্তায় যানজট ঢাকার ফার্মগেট থেকে একটুও কম না; যার মূল কারণ, শহরের রাস্তাঘাটের ভয়াবহ দুরবস্থা। কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিকেরা নিয়মিত এ ব্যাপারে প্রতিবেদন করছেন।

সন্ধ্যা নামলে পর্যটকেরা মুখোমুখি হন স্থানীয় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল এলাকায় চুরি-ছিনতাই নিয়মিত একটি বিষয়। রোহিঙ্গা ও শরণার্থী কমিশনের সামনের রাস্তায়, শহীদ মিনারের সামনে, জাইল্লার মোড়ে, বিজিবি ক্যাম্পের আশপাশে, পুলিশ লাইনসের সামনের রাস্তায় অনেককে ছুরিকাহত হতে শুনেছি। অনেক বিদেশি সংস্থা তাদের কর্মীদের রাতে কক্সবাজারে ঘোরাঘুরি করতে নিরুৎসাহিত করে। সম্প্রতি আলোচিত একটি ধর্ষণের ঘটনায় অনেকেই শঙ্কিত। কক্সবাজারে নিরাপত্তায় আরেক সমস্যা কোভিড-১৯। পর্যটক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা এবং সেবায় জড়িত বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করেন না। আমি কয়েকজন হোটেলকর্মীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁদের উত্তর ছিল, ‘আমরা করোনাকে ভয় পাই না।’ ডিসি অফিস থেকে পর্যটকদের দেওয়া বিনা মূল্যর মাস্ক দিয়ে নোংরা হয়েছিল সমুদ্রসৈকত। আমাদের পর্যটকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার একটি উদাহরণ ছিল সেটি।

কক্সবাজারে পর্যটকদের একটা অংশ আসে সস্তায় মাদকের সহজলভ্যতার কারণে। এখানে সন্ধ্যায় হোটেলের বারান্দায় বসলে গাঁজার গন্ধ পাওয়া যায়। এখানে রিকশাওয়ালারা জিজ্ঞেস করেন, ‘মামা, কিছু লাগব?’ এই কিছু বলতে হরেক রকম মাদক আর পতিতা বোঝানো হয়। রিকশাওয়ালারা এখানে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সব ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উঠতি বয়সের অনেক ছেলেমেয়ে কক্সবাজারে আসেন এই মাদক আর অসামাজিক কর্মকাণ্ডের হাতছানিতে। ঢাকার ধনীর দুলাল-দুলালিরা বন্ধুদের সঙ্গে এসে মাদক আর বন্ধুদের ধর্ষণে মৃত্যুবরণ করেছেন, এমন সংবাদও আমাদের পড়তে হয়েছে।

কক্সবাজারের সমস্যাগুলোর পেছনে শুধু কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা দায়ী নন। এখানে বেশির ভাগ পর্যটক আসেন কোনো পরিকল্পনা ছাড়া। আমি দেখেছি, মধ্যরাতে মা এক হাতে কয়েক মাসের ছোট্ট শিশু, আরেক হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে স্বামীর পেছনে হাঁটছেন আর খুঁজছেন কোনো হোটেলে একটু জায়গা পাওয়া যাবে কি না। উত্তরাঞ্চল থেকে অনেকে আসেন বাস ভর্তি হয়ে। তাঁরা রাস্তার পাশে রান্না, খাওয়া, টয়লেট সারেন আর ঘুমান বাসে। অতিরিক্ত পর্যটক স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনুপ্রাণিত করে অতিরিক্ত মুনাফা করতে। পর্যটকেরা যদি আসার আগে বাস/প্লেন আর হোটেল নিশ্চিত করে এখানে আসেন, তাহলে দেড় লাখের জায়গায় পাঁচ লাখ পর্যটক আসবেন না আর ব্যবসায়ীদের সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবকিছুর দাম নাগালের মধ্যে থাকবে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পর্যটকদের উন্মাদনা পরিহার অপরিহার্য। কিশোর-কিশোরীদের বুঝতে হবে মাদক কত ভয়ংকর।

কক্সবাজার বয়কট করে কোনো টেকসই সমাধান আনবে, তা আমি মনে করি না। কক্সবাজারের সমস্যাগুলো সমাধানে প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ, পর্যটক—সবার ভূমিকা রয়েছে। শুধু একপক্ষের দ্বারা এই বিচিত্র সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। প্রশাসন অবগত তাদের কী করতে হবে। প্রয়োজন যথাযথ ও অধিকতর প্রচেষ্টা। স্থানীয় জনগণ অবগত কারা ছিনতাই ও মাদকের ব্যবসায় জড়িত। তারা প্রশাসনকে সাহায্য করলে নিরাপত্তা দ্রুত আরও মজবুত হবে। ‘বয়কট’-এর বদলে পর্যটকদের নিয়ন্ত্রিত সংখ্যায় ভ্রমণ করতে হবে। থাকার জায়গা ঠিক না করে ভ্রমণ না করলে, মাদক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকলে এবং অনিরাপদ এলাকাগুলো এড়িয়ে চললে ভ্রমণ আনন্দময় করা সম্ভব। আসুন, আমরা কক্সবাজার ‘বয়কট’ না করে পরিকল্পিত ভ্রমণ করার মধ্যমে কক্সবাজারের সৌন্দর্য উপভোগ করি এবং নিজেদের অযাচিত সমস্যা থেকে রক্ষা করি। আপনার ভ্রমণ হোক পরিকল্পিত, নিরাপদ ও আনন্দময়।

মাহমুদ আল হক পাটোয়ারী উন্নয়নকর্মী।