কখন একটি নগর অনুপ্রাণিত করে?

একটা অনুপ্রাণিত করা শহরকে কীভাবে চিনব?প্রথম আলো

গত বছর কয়েকজন শিক্ষার্থী তাঁদের একটি পরীক্ষামূলক গবেষণার অংশ হিসেবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কীভাবে একটি অনুপ্রাণিত করা শহর তৈরি হতে পারে? কোন ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ একটি শহরকে মানবিক করে তোলে? ভাবার মতো বিষয়। সহজ কোনো উত্তর নেই। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর বা উত্তরগুলো জানা জরুরি, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে আর আলোচনা চলছে কী ধরনের নগর আর নগর সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, ভবিষ্যতের জন্য, মানুষের জন্য, উন্নয়নের জন্য আর পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য।

১৯৭১ সালে আমাদের নগরে জনসংখ্যা ছিল মাত্র শতকরা ৭ ভাগ, যেটা এখন ৩০ ভাগ। ভালো-মন্দের বিচারে না গিয়ে ধরে নেওয়া যায়, দ্রুত নগরায়ণের ফলে তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন নগর সংস্কৃতি, নগর অর্থনীতি, নগর মানসিকতা আর উন্নাসিকতাও। নগরে উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সব অর্থনৈতিক শ্রেণির মনোজগৎ বিবর্তিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে।

নগরজীবনের বিভিন্ন ধারা নগরবাসীদের মানসিকতার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেটা নিয়ে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী গিওর্গ জিমেল ১৯০৩ সালে ভীষণ তীক্ষ্ণ একটা রচনা লিখেছিলেন। সেই রচনার শিরোনাম ছিল ‘মহানগর আর মানসিক জীবন’। জিমেলের তর্কটা ছিল এ রকম—বিশাল জনগোষ্ঠী আর হরেক রকম বাহ্যিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শহরে নগরবাসী একধরনের ব্যক্তিগত সামাজিক প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। কোনো কিছুতেই আর প্রতিক্রিয়া না দেখানোর আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়। এতে সার্বিকভাবে যা হয়, তা হলো নগরের বিমানবায়ন।

আমি ভাবছিলাম শিক্ষার্থীদের সেই প্রশ্ন নিয়ে। কোন ধরনের শহর সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে? আত্মকেন্দ্রিক মানুষে ঠাসা, কংক্রিটের জঙ্গলে ভর্তি আর শুধু কিছু মানুষের সুবিধার শহর কখনই বাসযোগ্য হতে পারে না, প্রেরণা দিতে পারে না।

অনেক ভেবে ওদের উত্তর দিলাম এভাবে—একটা শহর অনুপ্রাণিত করে তখনই, যখন সামাজিক ন্যায়বিচারের একটা বলিষ্ঠ সংস্কৃতি প্রত্যেক নগরবাসীকে স্পর্শ করে, শক্তিশালী করে নগর ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠানগুলোকে। শুধু চাকচিক্য, উঁচু দালান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ধনী শ্রেণির জন্য তৈরি ঝকঝকে পার্ক আর দামি গাড়ির সমারোহ কখনই একটা শহরকে মানবিক করে তোলে না। তখনই নগরে একটা ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি তৈরি হয়, যখন জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার সুযোগ সবার জন্য নৈতিকভাবে সমান থাকে।

কিন্তু ন্যায়বিচারের বিষয়টা তো বিমূর্ত। এটা তো দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যাপার। সেটা কী করে নগরের শারীরিক বাস্তবতায়, নগরের রাস্তা-ঘাটে আর জনচত্বরে, দোকানে আর গণপরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হতে পারে? এসব চিন্তা করতে গিয়ে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ কবি আর সামাজিক অধিকারকর্মী মায়া এঞ্জেলোর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, ‘যেদিন থেকে আমি আমেরিকার বর্ণবাদী দক্ষিণ অঞ্চলে একটি ছোট্ট বিভাজিত গ্রন্থালয়ে প্রথম নিজের মতো করে, কোনো ভীতি ছাড়া, একটা বই পড়তে পেরেছিলাম; যেদিন আমি নিউইয়র্ক শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে কোনো শ্বেতাঙ্গের অবহেলা ছাড়া, বিনা সংকোচে ঢুকতে পেরেছিলাম, তখনই বুঝেছিলাম, যে শহরে আমি একটা গ্রন্থালয়ে অবাধ প্রবেশাধিকার পাব, কারও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একটা বই পড়তে পারব, আমি সেখানে ভালো থাকব। এটা আমার শৈশবের শিক্ষা।’ এটাই সামাজিক ন্যায়বিচার, নগরে আর নগর সংস্কৃতিতে। এটার বহিঃপ্রকাশ আর চর্চা অনেকভাবে হতে পারে। একটা উদাহরণ এভাবে দেওয়া যেতে পারে—একটা নগর গ্রন্থালয়, যেখানে সব অর্থনৈতিক শ্রেণির মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে। গ্রন্থালয়ের অতিরিক্ত চাকচিক্য আর অতি উৎসাহী, রক্ষণশীল প্রবেশনীতি কিন্তু অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে ফেলতে পারে নিম্নবিত্তের একজন তরুণ বা তরুণীর জন্য।

বৈষম্যহীন নগর ব্যবস্থাপনায় আসলে টেকসই, মানুষকেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। নগরের গণপরিবহনের কথা ভাবা যেতে পারে। যে গণপরিবহনব্যবস্থা নারীবান্ধব নয়, সেটা সামাজিক অন্যায়।

আমি ভাবছিলাম সামাজিক ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতে আমাদের শহরগুলোর অবস্থান কোথায়। এই আলোচনা আবশ্যিকভাবে রাজনৈতিক। বর্তমানের উদার আর উন্মুক্ত বিশ্বায়নের যুগে, বিশেষ করে যখন এডাম স্মিথিও লাভকেন্দ্রিক, অবমুক্ত অর্থনীতির জয়জয়কার চলছে, ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ ধরনের আলোচনাকে খুব অনায়াসে উন্নয়নবিরোধী, বামকেন্দ্রিক রাজনীতি বলে উপেক্ষা করার প্রবণতা থাকে। এই অর্থে সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টা রাজনৈতিক। এই রাজনীতিকরণ পশ্চিমা বিশ্বে প্রায়শই হচ্ছে। কিন্তু এটাকে মানবতার, মানবিকতার একটা বিষয় হিসেবে হিসেবে দেখলেই একটি বৈষম্যহীন নগর ব্যবস্থা আর সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব।

বৈষম্যহীন নগর ব্যবস্থাপনায় আসলে টেকসই, মানুষকেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। নগরের গণপরিবহনের কথা ভাবা যেতে পারে। যে গণপরিবহনব্যবস্থা নারীবান্ধব নয়, সেটা সামাজিক অন্যায়। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের এক নগর গবেষণায় আমরা দেখেছি, বাসে-ট্রেনে-টেম্পোতে কর্মজীবী নারীরা কীভাবে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হন, গণপরিবহনে বিরাজ করছে যৌন নির্যাতনের এক অদৃশ্য অপসংস্কৃতি। এটা যে শুধু আমাদের দেশের একক সমস্যা, তা কিন্তু নয়। দিল্লিতে এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে পাতাল রেলে মহিলাদের জন্য আলাদা কম্পার্টমেন্ট রাখা হয়েছে। এই জেন্ডারভিত্তিক গণপরিবহন পলিসিও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে, তা-ও নয়। দিল্লিতে গবেষণা সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, অনেক কর্মজীবী নারী এই ব্যবস্থা পছন্দ করেন না। কারণ, তাদের মতে বিভাজন নয়, গণপরিবহনে মানবিক, সভ্য সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, যেখানে নারী-পুরুষ সমান অধিকারে, কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া চলাচল করতে পারবে। এই বিতর্ক করার অধিকারও সামাজিক বিচারের অংশ হওয়া জরুরি।

যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম, একটা অনুপ্রাণিত করা শহরকে কীভাবে চিনব? শহরের বাস্তবতায় সামাজিক ন্যায়ের ব্যাপারটা কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর তাত্ত্বিকভাবে দেওয়া যেতেই পারে। সবচেয়ে ভালো উত্তর পেতে হলে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই, ঢাকার গণপরিবহনে এক দিন চলাচল করুন। শাহবাগকে যদি গণচত্বর বলা যায়, তাহলে ওখানে গিয়ে দেখুন, সেখানে আপনি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করে, পুলিশের মার না খেয়ে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন কি না। অথবা দেখুন চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে কিশোর-কিশোরীরা অবাধে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলতে পারছে কি না (এখানে আমি নিজে ক্রিকেট খেলে বড় হয়েছি, কিন্তু একজন প্রাক্তন মেয়র সম্প্রতি এখানে বানিয়েছেন প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত একটি সুইমিংপুল। বৈষম্যমূলক নগরায়ণের উদাহরণ আর কীভাবে দেব? )। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৫০-এর দশকে তৈরি করা নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার ফ্রেডেরিক ল ওমস্টেডের শর্ত ছিল, এই পার্ক শহরের সবার জন্য অবমুক্ত থাকতে হবে। এই পার্ক শুধু বিত্তবানদের বিনোদনের জায়গা হতে পারবে না, হতে হবে সব মানুষের অধিকারের জায়গা। আজকাল বাসযোগ্য শহরের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, নগর সেবায় সবার গণতান্ত্রিক প্রবেশাধিকার।

মূল কথা হচ্ছে, নগরব্যবস্থা আর পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকতে হবে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা আর মানুষকেন্দ্রিক অর্থনীতি তৈরি করার একটি সাহসী, যুগোপযোগী আর বৈষম্যহীন সংস্কৃতি।

আদনান জিল্লুর মোর্শেদ: স্থপতি, নগরবিদ ও অধ্যাপক ।

[email protected]