কখন ও কীভাবে বিদ্যালয় খুলতে পারে

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার সময় জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রধান প্রশ্ন, কখন, কীভাবে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হবে। করোনা অতিমারি পরিস্থিতিতে কখন ও কীভাবে বিদ্যালয়গুলো খোলা যেতে পারে, এই বিষয়ে এডুকেশন ওয়াচ একটি গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই সমীক্ষার প্রধান গবেষক হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করেছি। সহযোগী গবেষক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের গবেষক দলের সমন্বয়ক ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

এই সমীক্ষার জন্য দেশের ৮টি বিভাগের ২৪টি উপজেলার ৭২টি এলাকায় জরিপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ২ হাজার ৯৯২ জন প্রাথমিক (৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি) ও মাধ্যমিকের (৮ম ও ৯ম শ্রেণি) শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে পরিচালিত এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

দুই পর্যায়ের এই সমীক্ষার প্রথম পর্যায়ের একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন ১৭ জানুয়ারি এক ওয়েবিনার সভার মাধ্যমে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়। গণসাক্ষরতা অভিযান এই সভার আয়োজন করেছিল।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন এডুকেশন ওয়াচের সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকজন সেই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, সাংসদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক।

জরিপে যে প্রধান তথ্যগুলো আমরা পেয়েছি

১. ৭৫% শিক্ষার্থী, ৭৬% অভিভাবক, ৭৩% জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ৮০% এনজিও প্রতিনিধি দ্রুত স্কুল চালু করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

২. ৫৮% শিক্ষক ও ৫২% উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে স্কুল খুলতে চান।

৩. শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ৬২% শিক্ষক পাঠ্যক্রম সংক্ষিপ্ত করে মূল বিষয়ে পাঠদান সমর্থন করেন। পরীক্ষায় সময় ব্যয় না করে পাঠদানে সময় দেওয়া তাঁরা সমর্থন করেন।

৪. শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের বড় অংশ (৪০ থেকে ৪৭ শতাংশ) মনে করেন, করোনার ক্ষতির প্রভাবে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির হার বাড়বে। ড্রপআউটের আশঙ্কা ও শিশুশ্রমের হারও বাড়বে।

৫. অধিকাংশ শিক্ষক ও অভিভাবক মনে করেন, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতাবিধি বজায় রাখা এবং শ্রেণিকক্ষে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে।

৬. প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেনি। ডিভাইস ও যোগাযোগের সমস্যা ছাড়াও প্রদত্ত পাঠের কার্যকারিতারও সমস্যা ছিল তাদের জন্য।

৭. ৬২% শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল বন্ধ অবস্থায় শিক্ষক বা অন্য কারও কাছ থেকে লেখাপড়ার বিষয়ে সহায়তা পায়নি।

৮. করোনার প্রভাবে ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালে ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা হারিয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ১০ শতাংশ। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তা ২ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। স্কুল বন্ধ থাকার সময় প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেনি বা করতে পারেনি। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী শিক্ষক বা অন্য কারও কাছ থেকে সহায়তা পায়নি বলে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে শিক্ষাসচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, তাঁদের তথ্য অনুযায়ী অনেক বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে যোগ দিয়েছে এবং শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রায় সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও একই ধরনের মন্তব্য করেন।

এই সমীক্ষার ভিত্তিতে ৬ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়: ১. পর্যায়ক্রমে স্কুল খুলতে হবে। গ্রাম এলাকায় ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং বড় শহর এলাকায় মার্চ মাসে ধাপে ধাপে স্কুল খোলা যেতে পারে। ২. স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য এলাকা ও বিদ্যালয়ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ৩. শিক্ষার ক্ষতিপূরণের জন্য ২০২১-২০২২ এর দুইসালা পরিকল্পনা নিতে হবে। ৪. শিক্ষকদের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রণোদনা ও ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বিশেষ সহায়তা প্রদানের জন্য এনজিওর সহযোগিতায় শিক্ষক সহকারী নিয়োগ দিতে হবে। ৫. উপজেলাভিত্তিক ও বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের জন্য অংশীজনদের নিয়ে কর্মদল গঠন করতে হবে। বর্তমান ও আগামী অর্থবছরে শিক্ষা বাজেটের ১০ শতাংশ উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনুপাতে শিক্ষা পুনরুদ্ধারের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। ৬. গণসাক্ষরতা অভিযান, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও বাংলাদেশ প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ নেটওয়ার্ককে (বিইএন) যুক্ত করে এলাকাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি, গণসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে সহায়তা ও অগ্রগতি পরিবীক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন তাঁর বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এই সমীক্ষাকে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ৯৮ শতাংশ সুপারিশের সঙ্গে একমত।’ কিছু ব্যাপারে হয়তো আরও বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম বলেছেন, করোনা উত্তরণের এক কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছে এবং এ জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সমীক্ষার সুপারিশ তাঁদের প্রণীত কর্মসূচির সঙ্গে অনেকাংশেই সংগতিপূর্ণ। প্রাথমিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম তাঁর মন্তব্যে জানান, তাঁরা স্কুল খোলার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা নিয়ে কাজ করছেন। সমীক্ষার তথ্য ও সুপারিশের সঙ্গে তাঁদের চিন্তা অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জরিপ ও তথ্যভিত্তিক সুপারিশের প্রশংসা করেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফিরে যাওয়ায় আগ্রহ এবং শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মনোবল তাঁকে আশান্বিত করে।

সভাপতির বক্তব্যে কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। কাজটি করা হয়েছে সমীক্ষায়। করোনার আঘাতে শিক্ষার বৈষম্য কতখানি বেড়েছে, তা-ও দেখা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

প্রতিমন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তারা স্কুল খুলে দেওয়াসম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট সুপারিশ সম্পর্কে মন্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকেন। নীতিনির্ধারকগণ এ ব্যাপারে এখনো দোলাচলে আছেন বলে মনে হয়।


ড. মনজুর আহমদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। শিক্ষাবিদ