কজন পাণ্ডিত্যের জন্য উপাচার্য হয়েছেন?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গত ৩০ আগস্ট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অফিসের সামনে তাঁর অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর হামলার সচিত্র বিবরণ টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ায় দেশবাসী মর্মাহত ও লজ্জিত। এই লজ্জাজনক ঘটনায় শাসক দলের অনেক নেতাও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার লজ্জা হচ্ছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতিক্রিয়া দেখে। তিনি নিশ্চিত নন, শিক্ষকদের ওপর আদৌ কোনো হামলা হয়েছে কি না। ছাত্র নামধারী হামলাকারীরা নাকি তাঁকে আন্দোলনরত শিক্ষকদের কবল থেকে রক্ষা করে তাঁর কক্ষে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছিল! সারা দেশের টেলিভিশন দর্শক যা দেখলাম, তা তিনি দেখতে নারাজ।
ছাত্রদের হাতে শিক্ষক নির্যাতনের এই মর্মন্তুদ ঘটনা দেখে চরম অপমানিত ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় বৃষ্টির মধ্যে ঘটনাস্থলের অনতিদূরে বসে থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল আত্মসমালোচনামূলক একটি উচ্চারণ, ‘আমার গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছা করছে। আমার ছাত্ররা শিক্ষকদের এভাবে অপমান করতে পারল?...’ জাফর আমার অনুজপ্রতিম। তাঁর বড় ভাই প্রয়াত হুতমায়ূন আহমেদ আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন। তাই তাঁকে উদ্দেশ করে সরাসরিই বলছি, এটা আমাদের লজ্জা নয়। আমরা তো শিক্ষক হিসেবে আমাদের গুরুদায়িত্ব পালনে কখনোই অবহেলা করিনি। অতএব, এ রকম একজন শিক্ষক কেন গলায় দড়ি দেবেন? গলায় দড়ি দেওয়া উচিত ওই সব রাজনীতিবিদের, যাঁদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো স্বাধীনতা
অর্জনের ৪৪ বছর পরও ছাত্র নামধারী লাঠিয়াল-মাস্তান-ক্যাডার লালন-পালনের ক্ষেত্র হয়েছে, আজও অপব্যবহৃত হয়ে চলেছে। আমাদের কলমগুলোকে আমরা শাণিত করে এসব সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের তল্পিবাহী শিক্ষক-ছাত্র নামধারীদের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য ব্যবহার করতে থাকব, এটাই তো আমাদের কর্তব্য।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ঘটনাটা এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে দুরারোগ্য দুটি ব্যাধিকে জাতির সামনে আবারও উন্মোচিত করে দিয়েছে। আবারও জোর দিয়ে বলছি, ব্যাধির মূল উৎস এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো ব্যবহারের অপসংস্কৃতি এবং দলগুলোর রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশকে বশংবদ দালাল বানানোর প্রতিযোগিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে পাস করে ১৯৭৩ সালের ১ আগস্ট আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ২০১৫ সালের ১ জুলাই অবসরপূর্ব প্রস্তুতিকালীন ছুটি কাটানো শুরু করেছি।
গত ৩৪ বছরে দেশ-বিদেশের বহু লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবন সম্পন্ন করেছি। গর্ব করে বলতে পারি, দায়িত্বে কখনো অবহেলা করিনি, আমার ক্লাসে যেতে বিলম্ব হয়নি কখনোই। কয়েক মাস আগে যখন এমএসএস শেষ পর্বের ছাত্রছাত্রীদের কোর্সের শেষ ক্লাসটি নিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হলাম, তখন অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, আমার ছাত্রছাত্রীরা পথের দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আমার ওপর পুষ্পবর্ষণ করে চলেছে। অন্তরের অকুস্থল থেকে উৎসারিত এই ভালোবাসাই শিক্ষকদের জীবনের পরম পাওয়া। আমি আমার শিক্ষকতা জীবনের ৪২ বছরে প্রতিনিয়ত এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ফল্গুধারায় অবগাহন করেছি।
১৯৭৩ সালে যে দেড় বছরের সেশন জ্যাম নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেছিলাম, তা এ দেশের সংঘাত ও খুনোখুনির রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে বাড়তে বাড়তে সাড়ে তিন বছরের সেশন জ্যামে পরিণত হয়েছিল ২০০১ সাল নাগাদ। তারপর অনেক সংস্কার এবং শিক্ষকদের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে গত দেড় দশকে ওই সেশন জ্যামকে আমরা দেড় বছরে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু সংঘাত-হানাহানি কমানোর কোনো প্রতিষেধক স্বাধীনতা অর্জনের ৪৪ বছরেও আমরা বের করতে পারলাম না! আর এটা কারও অজানা নয় যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘন ঘন অচলাবস্থার শিকার হয়ে চলেছে তিন দশক ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে আমি ছাত্রলীগের মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসেবে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। ‘স্বাধীনতা নিউক্লিয়াসের’ সদস্য হওয়ার সৌভাগ্যও হয়েছে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল আইয়ুব-মোনেমের এনএসএফের মাসলম্যানরা। তদানীন্তন জিন্নাহ হলে (বর্তমান মাস্টারদা সূর্য সেন হল) এনএসএফের কয়েকজন মাসলম্যানের ডাবল কাপ খাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে ১৯৬৮ সালে তাদের নির্যাতনের শিকারও হয়েছিলাম একবার।
স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের বিভক্তির পথ ধরে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস ফিরে এসেছিল ১৯৭২ সালেই, তারপর ক্রমেই তা বাড়তে বাড়তে ডাকসুর ব্যালট ছিনতাই ও সাত খুনের ঘটনা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৭২ সালে ওই রকম এক সন্ত্রাসী আক্রমণের সময় হলের ছাদের পানির ট্যাংকের তলায় লুকিয়েছিলাম কয়েকজন।
১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াটা আমার কাছে অনৈতিক মনে হয়েছে, ব্যাপারটাকে এখনো আমি অনৈতিক মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নানা নির্বাচনে আমি বহুবার অংশ নিয়েছি, নির্বাচিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেছি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সারা দেশের শিক্ষকদের আন্দোলন–সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও সরাসরি রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে আমার অবস্থান এতটুকুও বদলায়নি, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শিক্ষকদের রাজনৈতিক দল করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আমার চোখের সামনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী ক্যাডারদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে দেখেছি। ৩৪ বছর ধরে এই ক্যাম্পাসটা ছাত্রসংগঠনগুলোর খুনোখুনি, মারামারি ও সন্ত্রাসের লীলাভূমি হিসেবে অপব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
১৯৭৩ সালের শেষের দিকে দুটি ছাত্রসংগঠনের মারামারি থামাতে গিয়ে দুই গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারদের মাঝখানে অবস্থান নিতে হয়েছিল। ১৯৮১ সাল থেকে ৩৪ বছর ধরে বহুবার আমাকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে ক্যাম্পাসের সংঘাত থামাতে, কিন্তু দমে যাইনি। সে জন্য আমি ৩৪ বছর ধরেই ছাত্ররাজনীতিকে মূল রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত করার ব্যাপারে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এই একটি বিষয়ে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অভিন্ন—সশস্ত্র ক্যাডার পালনের সংস্কৃতি তারা কেউ পরিত্যাগ করতে রাজি নয়। বরং এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একাংশ নানা পদের লোভে মূল রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা-কর্মীতে পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ এখন আর শিক্ষকের পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয় না, তদবিরের প্রতিযোগিতায় কার পারদর্শিতা কতখানি, তারই ন্যক্কারজনক প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই সময়ে দেশের বিদ্যমান চারটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন। ওই সময়ের সেরা পণ্ডিতদের তিনি নিজে টেলিফোন করে রাজি করিয়েছিলেন উপাচার্য পদ গ্রহণের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিংবদন্তিসুলভ খ্যাতির অধিকারী প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী (ম্যাক)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বানানো হয়েছিল প্রফেসর খান সরওয়ার মুরশিদকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর ইন্নাস আলী। কিন্তু তিনি তখনকার ছাত্ররাজনীতিকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করলেন, তখন দেশবরেণ্য সাহিত্যিক আবুল ফজলকে উপাচার্য হওয়ার জন্য টেলিফোনে অনেক দেন-দরবার করে রাজি করিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার জন্য আরেকজন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ এনামুল হককে বঙ্গবন্ধু অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলেন।
অধ্যাপক আবুল ফজল ও অধ্যাপক এনামুল হক দুজনই সরকারি চাকরি থেকে বহুদিন আগেই অবসর গ্রহণ করা সত্ত্বেও জাতির পিতার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাঁরা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁদের পাণ্ডিত্যকে সম্মান জানিয়ে ওই পদগুলোতে দায়িত্ব প্রদানের কারণে। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে নবগঠিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত করায় তাঁর স্থলে উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন দেশের আরেকজন খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী।
১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ এবং অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইন প্রণীত হওয়ার পর ওগুলোর অধীনে উপাচার্য নিয়োগ শুরু হয়েছিল স্বৈরাচার এরশাদের আমলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়েছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দ্বিতীয় হয়েছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। কিন্তু এরশাদ তাঁদের কাউকে মনোনীত না করে, যিনি তৃতীয় হয়েছিলেন তাঁকেই উপাচার্য পদ দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা। মানে, সরকারপ্রধানের কাছে তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য হওয়াটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল।
১৯৯১ সালে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এই নিয়মটা দলবাজ ও তদবিরবাজ শিক্ষকদের পুরস্কৃত করার রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে তদবিরের মাধ্যমে উপাচার্য পদ দখল এবং গায়ের জোরে উপাচার্য উৎখাতের সংস্কৃতি ক্রমেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। এই পর্যায়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কজন পাণ্ডিত্যের জন্য উপাচার্য হয়েছেন?
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।