কত পাল্টে গেছে আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের রাজনীতি দলকেন্দ্রিক। এ নিয়ে দলাদলি এবং দলবাজি আছে বিস্তর, দলের ভেতরে এবং এক দলের সঙ্গে অন্য দলের। তারপরও দল ছাড়া রাজনীতির কথা ভাবা যায় না। এ দেশে কয়টি দল, তার কোনো হিসাব নেই। নির্বাচন কমিশনে যারা নিবন্ধিত, তারা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে পারে। সে জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হয়। যাদের মার্কা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তাদের অনেকেরই দল আছে। প্রতিটি দলই নিজেকে রাজনীতির জন্য অপরিহার্য মনে করে এবং জনসেবার সুযোগ চায়।

অনেক সিনেমায় দেখা যায়, নায়ক একাই লড়ে চলেছেন ডজন ডজন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ছুরি-বল্লম-পিস্তল-তলোয়ার নিয়ে যত লোকই তাঁকে আক্রমণ করুক না কেন, নায়ক ঢিসুম ঢিসুম কিলঘুষি আর উড়ন্ত লাথি দিয়ে সবাইকে কুপোকাত করে ফেলেছেন নিমেষেই। মাঝেমধ্যে অবাক হই, কী করে একজনের পক্ষে এতগুলো লোককে পিটিয়ে কাবু করে অক্ষত অবস্থায় টিকে থাকা সম্ভব! সিনেমায় এটাই হয়। এভাবেই লেখা হয় চিত্রনাট্য।

বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থাও অনেকটা এ রকম। এত দলের ভিড়ে একটি দল কেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দলটির নাম আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ একটি পুরোনো দল। বয়স একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তরে পড়েছে। কিন্তু এখনো তাগড়া মনে হয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল কয়েক দফায়। ২০০৯ সাল থেকে দলটি আবারও ক্ষমতায়।

শুরুর দিকের দুই দশকে আওয়ামী লীগের মূল ভরসা ছিল ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ যদিও আওয়ামী লীগের চেয়ে বয়সে দেড় বছরের বড়, তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের শক্তির ভিত তৈরি করেছেন ছাত্রলীগের তরুণেরা। একদা ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান হয়েছে তরুণদের ওপর নির্ভর করেই। বলা যায়, তরুণেরা তাঁর নেতৃত্বের আস্থা রেখেছিলেন। এভাবেই শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন এ দেশের প্রধান নেতা, বঙ্গবন্ধু। তারপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

স্বাধীনতার পর অবস্থা পাল্টাতে থাকে। পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর দলটি তছনছ হয়ে যায়। শুরু হয় ভাটার টান। তারপর বৈরী স্রোতের বিরুদ্ধে উজানে যাওয়ার চেষ্টা। এই পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালে দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তাঁকে কেন্দ্র করে দলের তরুণেরা আবারও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। সামরিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ একক শক্তিতে পুরোনো অবস্থানে যেতে পারেনি। তাই সে জোটবদ্ধ হয় অন্যান্য দলের সঙ্গে। সংসদীয় রাজনীতিতে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠন করার মতো নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল না। ফলে সাহায্য নিতে হয় জাতীয় পার্টির ও জাসদের।

ওবায়দুল কাদের সাহেব কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ অপরিহার্য নন।’ তিনি এটি প্রকাশ্যেই বলেছেন, টেলিভিশনে এটা তাঁর মুখ থেকেই শুনেছি। প্রশ্ন জাগে, যে দলে একজন মাত্র অপরিহার্য, তাঁকে আমরা দল বলব কি না।

২০০১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ জোটের রাজনীতিতে আরও বেশি আস্থাবান হয়। তৈরি হয় ১৪-দলীয় জোট। আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে ছোট শরিকদের আস্থায় নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগে একচেটিয়া জয় পায়। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারে। ১৪-দলীয় জোট আছে, তবে তা এখন আওয়ামী লীগের প্রয়োজনে যতটা না, তার চেয়ে বেশি শরিকদের প্রয়োজনে। আওয়ামী লীগকে ছাড়লে তাদের অনেককেই হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হবে। শরিকদের এক নেতা একবার হুংকার দিয়ে আশি পয়সা-বিশ পয়সা-দশ পয়সার একটা হিসাব দিয়েছিলেন। পরে তাঁকে কথা ফিরিয়ে নিতে হয়েছিল।

শুরুতেই বলেছিলাম, আওয়ামী লীগের মূল শক্তি ছিল ছাত্রলীগ। ১৯৬৯ সালে তৈরি হলো সহযোগী সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগ। ১৯৭০ সালে মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরির নেতৃত্বে বানানো হলো আওয়ামী ওলেমা পার্টি। বাহাত্তরে তৈরি হলো বাংলাদেশ কৃষক লীগ এবং আওয়ামী যুবলীগ। ১৯৭০ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এটি এখন হয়েছে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। বাহাত্তরে শ্রমিক লীগের ব্যানারে তৈরি হয়েছিল লালবাহিনী। এটি লুপ্ত হয়েছে, সে যা-ই হোক, সহযোগী সংগঠনগুলো এখন আর আওয়ামী লীগকে শক্তি জোগায় না।

আওয়ামী লীগ থেকেই তারা শক্তি পায়। এর প্রধান কারণ হলো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রক্ষমতা। এ দুইয়ের সংমিশ্রণে যে শক্তি তৈরি হয়েছে, অন্য সবাই তার মুখাপেক্ষী।

দল মানেই একগুচ্ছ মানুষ। একা একা দল হয় না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত লাখ লাখ নেতা, কর্মী, সমর্থক। তারপরও প্রশ্ন জাগে, এটি কি আগের মতোই কার্যকর একটি দল? দুটি কারণে এই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বলেছেন, সবাইকে কেনা গেলেও তাঁকে কেনা যায় না। ইঙ্গিতটি তিনি দিয়েছেন তঁার দলের প্রতি। তাঁর বাবার (বঙ্গবন্ধু) লাশ ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে পড়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দলের কেউ সেখানে যাননি বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন। তাঁর এই অভিযোগ দলের বিরুদ্ধেই।

ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অনেকেই মনে করেন, এ পদ দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির। যদিও এ ধরনের রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে কেউ থাকেন না। একজন শীর্ষ নেতা থাকেন, আর থাকেন অন্যরা। তারপরও এই পদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। একসময় শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

সেই জায়গায় ওবায়দুল কাদের! এ নিয়ে কথা হয় নানা রকম।

তো ওবায়দুল কাদের সাহেব কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ অপরিহার্য নন।’ তিনি এটি প্রকাশ্যেই বলেছেন, টেলিভিশনে এটা তাঁর মুখ থেকেই শুনেছি। প্রশ্ন জাগে, যে দলে একজন মাত্র অপরিহার্য, তাঁকে আমরা দল বলব কি না। তাঁর এ কথার মধ্য দিয়ে একটা নির্মম সত্য বেরিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনা ছাড়া আর যাঁরা এই দলে আছেন, তাঁদের থাকা না থাকা সমান। নিজেদের প্রয়োজনেই তাঁরা দলে ঢুকেছেন, আছেন।

এই যদি হয় আওয়ামী লীগের অবস্থা, তাহলে তার শক্তির উৎস কোথায়? জনগণ? নেতার সঙ্গে জনতার সংযোগের মাধ্যম কি দল নয়? সংযোগটি তাহলে কোন প্রক্রিয়ায় হয়?

দলের সভাপতির আক্ষেপ এবং সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্য শুনে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দলটি এক ব্যক্তিনির্ভর। শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্ব এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে পারিবারিক ক্যারিশমা তাঁকে দলের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অপরিহার্য করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে তাঁর প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে জুটেছেন অনেকেই। এই সত্য উপলব্ধি করার জন্য ওবায়দুল কাদের সাহেবের তারিফ করতে হয়।

দেশে কয়েকটি ধাপে পৌরসভা নির্বাচন হচ্ছে। ২৩ ডিসেম্বর প্রথম ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন ৬৪ শতাংশ ভোট। ‘প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী’ বিএনপি প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৩ শতাংশ। ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ১৪টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিএনপি পেয়েছে গড়ে ১৮ শতাংশ ভোট। ভোটের এই হিসাব বলে দেয়, আওয়ামী লীগ সম্ভবত এই মহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। ভোটের এই ফলাফল অস্বীকার করি কীভাবে? প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, যারা হেরে যায়, তারা কারচুপির অভিযোগ তোলে, এমনকি আমেরিকায়ও। অকাট্য যুক্তি!

রাষ্ট্রক্ষমতা এক ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগের নৌকা ভেসে চলেছে। সেই নৌকায় ওঠার জন্য সর্বত্র লম্বা লাইন, তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সবাই নৌকার টিকিট চান। মারামারি, খুনোখুনি করে হলেও নৌকায় সওয়ার হতে হবে। তাহলেই হাতে আসবে জনসেবার সুযোগ। সেই সঙ্গে অর্থবিত্ত আর প্রতিপত্তি। এই জোয়ারে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের আওয়ামী লীগকে খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

[email protected]