কত শিশু কাজ করত ওই মৃত্যুকূপে

জুস, ক্যান্ডি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাইসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায়। প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক দিয়ে চলত তাদের কাজ। কর্মরত শিশু-কিশোর, শ্রমিক-জনতা পেটের আগুন জুড়ানোর জন্য মাত্র সপ্তাহখানেক আগে (১ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার) রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। দুই মাস ধরে তাঁদের বেতন ও ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করছিল না মালিকপক্ষ। বাড়িভাড়া ও মুদিদোকানের বকেয়া পরিশোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই তাঁরা শিকার হলেন কারখানার রহস্যময় আগুনের। মালিক বলেছেন, আগুন লাগতেই পারে। কী কঠিন পরিহাস!

১ জুলাই বিক্ষোভের খবর পেয়ে কাঁচপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও ভুলতা ফাঁড়ি পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ এনেছিল। গলা উঁচু করে জানিয়ে গিয়েছিল, ‘মালিকপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। ৫ জুলাই শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া ওভারটাইমের টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। বাকিটা ঈদের আগে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। কোম্পানির অ্যাডমিন ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিনও সংবাদমাধ্যমকে একই কথা বলেছিলেন। বলা বাহুল্য, কেউ কথা রাখেনি। পেটের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে কারখানার আগুনের পুড়ে কয়লা হলেন তাঁরা।

শুক্রবার সন্ধ্যায় এক উদ্ধারকর্মী কাঁদতে কাঁদতে জানান, চেনা যায় না কে নারী কে পুরুষ, কোনটা মাথা, কোনটা হাত। মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে নারী, পুরুষ কিংবা পরিচয়—কারও পক্ষে কোনো কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। বিক্ষুব্ধরা বলছেন, চারতলায় ‘দরজা বন্ধ’ না থাকলে এত মৃত্যু হতো না। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস আর লাঠির বাড়ি খেয়েও শিশুকন্যার খোঁজে আসা হাতেম আলী ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানাল, পাঁচ-ছয়তলায় কোনো লাশ মেলেনি।

ঢাকা থেকে ছুটে যাওয়া সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ সেটা শুনে স্তব্ধ, ‘এটা অসম্ভব’। নিচের সিঁড়ি আগুনে বন্ধ হওয়ায় সবাই ওপরে উঠে গিয়েছিল। ছাদের তালা খোলা না বন্ধ ছিল, জানা নেই। পাঁচ-ছয়তলায় অনেকে আটকা পড়ার কথা। তাঁদের লাশ কোথায় গেল? একটা হাজিরা খাতা পড়ে ছিল, পৃষ্ঠাগুলো ছেঁড়া।

তালা মারার অভিযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ বিবিসিসহ সবাইকে বলেই চলেছে, ‘এটি মিথ্যা কথা, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ তাহলে সত্য কোনটা? তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ডিসি মহোদয় এবং ডিআইজির সঙ্গে কথা হয়েছে। এটা আমাদের মালিকপক্ষ দেখবে। এদের ক্ষতিপূরণ সম্পূর্ণ ম্যানেজমেন্ট দেবে।’ নাছোড়বান্দা তরুণ সাংবাদিক জানতে চান, তালা দেওয়া না থাকলে এতগুলো বডি এক জায়গায় পাওয়া গেল কীভাবে? মালিকপক্ষের উত্তর, ‘যখন নিচতলায় আগুনটা ধরেছে, তখন সবাই আতঙ্কে ওপরে চলে গেছে।’ তাই বোকা লোকগুলো পুড়ে কয়লা হয়েছে একসঙ্গে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় এক উদ্ধারকর্মী কাঁদতে কাঁদতে জানান, চেনা যায় না কে নারী কে পুরুষ, কোনটা মাথা, কোনটা হাত। মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে নারী, পুরুষ কিংবা পরিচয়—কারও পক্ষে কোনো কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। বিক্ষুব্ধরা বলছেন, চারতলায় ‘দরজা বন্ধ’ না থাকলে এত মৃত্যু হতো না।

বিকেল পাঁচটায় আগুন লাগার পর অনেকেই মুঠোফোনে ফোন দিয়েছিলেন কাছের মানুষদের, কেউ মাকে, কেউ বাবাকে, স্ত্রীকে, স্বামীকে। জেনে গিয়েছিলেন, এটাই তাঁদের কেয়ামত, শেষ দিন। না হলে বাঁচার কথা ভুলে জীবনের ভুলত্রুটির জন্য শেষবারের মতো ক্ষমার আকুতি কেন জানাবেন?

লাশ গণনা শেষ হওয়ার আগেই অনেক শ্রমিক আর মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি পৌঁছে গেছে সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলে। এসব বিবৃতিতে সস্তা শিশুশ্রমের অব্যাহত অপব্যবহার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হয়েছে মৃতের সংখ্যা। তাজরীন, রানা কি হা–মীম অথবা নরসিংদীর তোয়ালে কারখানা কিংবা গাজীপুরের চান্দনায় গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানা—কোথাও কি নিখোঁজের সব হিসাব কোনো দিন পাওয়া যাবে?

অপেক্ষমাণ অভিভাবক আর জানে বেঁচে যাওয়া সহকর্মীদের কাছ থেকে যেসব নাবালক-নাবালিকার নাম পাওয়া গেছে, সেটাই এখন একমাত্র তালিকা। এসব সুরক্ষিত গারদ নামের কারখানায় চৌদ্দগুষ্টির নাম-ঠিকানা না লিখে কি ঢোকা সম্ভব? যাঁরা লাইসেন্স দেন, নবায়ন করেন, সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান কলকারখানা পরিদর্শকের অফিস বলছে, ‘আমাদেরই ঢুকতে দেয়নি বারবার অনুরোধ করার পরও।’

শান্তা (১২), মুন্না (১৪), শাহানা (১৫), নাজমুল (১৫), রিপন (১৭), তাকিয়া (১৪), হিমু (১৬), সুফিয়া (৩০), আমেনা (১৭), মাহমুদ (১৫), তাসলিমা (১৭), কম্পা (১৬) ছাড়াও আরও যে অনেক শিশু ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা ছাড়া যাদের বয়স ১৯-১৮ বলা হচ্ছে, যেমন শেফালি (২০), ইসমাইল (১৮), অমৃতা (১৯)—তাঁদের প্রকৃত বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁদের সহকর্মীরা।

দেশের প্রচলিত আইন শিশুদের কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগকে অনুমোদন করে না। আইনে বলা হয়েছে, ‘কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না।’ তবে শিশু আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলা হলেও বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি, এমন কোনো ব্যক্তিকে ‘শিশু’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে কি ১৪ বছর পার হলেই সবাই প্রাপ্তবয়স্ক? না, তা নয়। শ্রম আইন প্রাপ্তবয়স্কের সুযোগ থেকে এই বয়সী মানুষদের বঞ্চিত রেখে তাঁদের কাছ থেকে সস্তা শ্রম কেনার একটা ব্যবস্থা করেছে। শ্রম আইন বলছে, ‘চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করিয়াছেন কিন্তু আঠারো বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই, এমন কোনো ব্যক্তিকে “কিশোর” হিসেবে গণ্য করা হইবে।’ এদের কারখানায় শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগ দেওয়া যাবে। কী সেই শর্ত?

শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে কিশোর শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক কিশোরকে প্রদত্ত সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র মালিকের হেফাজতে থাকতে হবে। কাজের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে কিশোরের কর্মঘণ্টা সম্পর্কে একটি নোটিশ প্রদর্শন করতে হবে।

তারপরও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার চাপেই হোক আর মুখরক্ষার জন্যই হোক, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রজ্ঞাপন (এসআরও নং ৬৫-আইন/২০১৩) জারির মাধ্যমে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটা তালিকা তৈরি করে জানিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। সেই তালিকায় যে ৩৮টি কাজে শিশু-কিশোরদের নিয়োগ না করার কথা বলা হয়েছিল, তার অন্তত চারটি লঙ্ঘন করার প্রমাণ মিলেছে এই কারখানায়।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় যখন আগুন লাগে, তখন কিশোরদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ কর্মঘণ্টা যে অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সর্বশেষ এই আগুন আবার সেই পুরোনো ক্ষতের দগদগে ঘাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে। নজরে আসছে নিয়মবহির্ভূত নির্মাণ, পরিদর্শন নেই, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে, অন্যথায় সহজে একত্র হয় না। সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে না। দুর্ঘটনার পর কয়েকটি কমিটি হয়। তারা কিছু সুপারিশ করে। কিন্তু সেসব সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়িত হলো কি না, এর ওপর কোনো নজরদারি থাকে না।

লাশ গণনা শেষ হওয়ার আগেই অনেক শ্রমিক আর মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি পৌঁছে গেছে সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলে। এসব বিবৃতিতে সস্তা শিশুশ্রমের অব্যাহত অপব্যবহার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হয়েছে মৃতের সংখ্যা।

ফায়ার সার্ভিসের আর কারখানা পরিদর্শনের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠছে কলকারখানা, সম্প্রসারিত হচ্ছে তাদের বহুতল ভবন। এ ধরনের অব্যবস্থাপনার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে চলেছে। কেউ জানে না কে নিশ্চিত করবে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণের ব্যাপারে কার কতটা নজরদারি ফরজ? ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়া কোনো ভবনের কার্যক্রম শুরু করতে দেওয়া ঠিক হবে কি না? তা ছাড়া কে কীভাবে নিশ্চিত করবে কলকারখানার জন্য উন্নত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার ও নিয়মিত মেরামত করার কাজ, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা ও কৃত্রিম জলাধার, ড্রামভর্তি পানি সংরক্ষণ, প্রশস্ত সিঁড়ি ও বিকল্প জরুরি বহির্গমনের পথ রাখা, কর্মকালীন গেট বন্ধ না করা।

অনেক দেশের মতো একসময় আমাদের দেশেও মোহিনী মিল, কেরু কোম্পানি, চিত্তরঞ্জন বস্ত্র মিল, এমনকি আদমজীতেও শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা যৌথ নিরাপত্তা কমিটি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এসব কাজ করত। নিশ্চিত করত শ্রমিকদের আর স্থাপনার নিরাপত্তা। দেখত সিঁড়িঘরে বা যত্রতত্র মালামাল না রেখে আলাদা গুদামে সংরক্ষণ হচ্ছে কি না, নিরাপত্তা প্রহরীর জন্য বিশেষ জরুরি টেলিফোন ব্যবস্থাসহ বিদ্যুৎ বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের টেলিফোন নম্বর শ্রমিকেরা জানেন কি না। কারখানায় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ হচ্ছে কি না।

আসলে আইন মানার সংস্কৃতি আর জবাবদিহি না থাকলে মানুষ মরবে, শিশুদের লাশের হিসাব মিলবে না, এ আর নতুন কী!

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]