কথা বলার অধিকার নেই তো কোনো অধিকার নেই

লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ফরাসি দার্শনিক ও ফরাসি বিপ্লবের অগ্রনায়ক ভলতেয়ারের নামে বহুল প্রচারিত ‘আমি আপনার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি কিন্তু আপনার বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন দিতে প্রস্তুত’ উক্তিটি মনে এল (এভলিন বিয়াট্রিস তাঁর ১৯০৬ সালে প্রকাশিত ফ্রেন্ডস অব ভলতেয়ার গ্রন্থে এভাবেই ভলতেয়ারকে উদ্ধৃত করেন)। আমরা ভুলে যাই বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও দুই দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত অধিকারের সঙ্গে কথা বলার অধিকারও যুক্ত। মতপ্রকাশের তথা কথা বলার ও লেখার অধিকার ছাড়া অন্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে, একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যে বিপন্ন হতে পারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি। বস্তুত আধুনিক সময়ে এই ব্যাপক অভিবাসনের যুগে জাতিরাষ্ট্রের ধারণাই এখন অচল। এখন শুধু রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়ই মুখ্য।

কার্ল মার্ক্স দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতার নিয়মে ক্রমেই উন্নত স্তরে পৌঁছায়। বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত নতুন জ্ঞানের দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষের ফলেই মানব সমাজের জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটে। অতএব, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত এই নতুন জ্ঞান তাঁকে প্রকাশ করতে দিতে হবে। না হলে সমাজে জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটবে না এবং সমাজ একদিন একটা বদ্ধ ডোবায় পরিণত হবে। প্রশ্ন হলো, বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে নতুন জ্ঞানের সংঘর্ষ কীভাবে হবে? আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক হলো সেই মাধ্যম, যা এই সংঘর্ষ তৈরি করে। বিতর্ক একটা সমাজে মোমেন্টাম তথা গতি তৈরি করে। এ গতিই সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ইউরোপ যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি করল, তার মূলে ছিল বিতর্ক ও অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। যেমন: পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইতালিতে শুরু হয়ে সমগ্র ইউরোপে ঘটে যাওয়া রেনেসাঁ, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের ও গ্লোরিয়াস রেভল্যুশনের মধ্য দিয়ে বিল অব রাইটস প্রতিষ্ঠা (যার প্রভাবে আমেরিকাতেও বিল অব রাইটস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল), চার্চের ওপর পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য, রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথক্‌করণ।

১৭৮৯-১৭৯৯ কাল পর্বে ফরাসি দেশে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব। রোগনির্ণয় ও আরোগ্য, আয়ু বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মৃত্যুহারের পতন, অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি, স্বাচ্ছন্দ্য তথা উন্নত আধুনিক জীবন যে শিল্পবিপ্লব সম্ভব করেছে, সেই শিল্পবিপ্লবের শিকড়ও প্রথিত ছিল উল্লিখিত ওই সব ঘটনাগুলোর মধ্যে, অর্থাৎ ওই ঘটনাগুলো না ঘটলে শিল্পবিপ্লব কখনোই ঘটত না এবং মানবজাতির পক্ষে আজকের এই উন্নত জীবন অর্জন সম্ভব হতো না। কারণ, এই ঘটনাগুলো ব্যক্তির চিন্তার, কর্মের ও সৃজনশীলতার পথ খুলে দিয়েছিল।

রেনেসাঁর নায়কেরা যখন ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-এর বিপরীতে ‘মানুষের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন, তখন তা ছিল বিরাজমান জ্ঞান, ধারণা বা তত্ত্বের ওপর বিরাট এক ধাক্কা অর্থাৎ বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে এই তত্ত্ব গভীর এক সংঘর্ষ সৃষ্টি করল। সমাজ যদি এ সংঘর্ষ মেনে না নিত, আজকের এই উন্নত আধুনিক পৃথিবী নির্মাণ মন্থর হয়ে যেত। জীবন মানের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন নীতিমালার কেন্দ্রে থাকতে হবে ইহজগৎ ও মানুষ।

শুধু লেখক বা কবি-সাহিত্যিকই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষেরই কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের বক্তব্য সব রাজনৈতিক সংগঠনকে এবং সরকারকে শুনতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনকে কালের স্পন্দন বুঝতে হবে আর কালের স্পন্দন মানেই মানুষের স্পন্দন। বস্তুত রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় যে জ্ঞান, তার উৎস হলো মানুষ-সাধারণ মানুষ। হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত এবং গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আটকাবস্থায় মৃত লেখক মুশতাক আহমেদের অপরাধ কী? তাঁদের অপরাধ হলো, তাঁরা এমন কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন যা সমাজের কিছু লোকের পছন্দ নয়। সেটা হতে পারে পরকালের চেয়ে ইহকালকে বড় করে দেখা, হতে পারে নিরীশ্বরবাদের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন, ভাবের চেয়ে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব প্রদান বা সরকারের সমালোচনা।

আপনি যদি আমার কথা পছন্দ না করেন, তাহলে আপনি আমার বক্তব্য খণ্ডন করুন এবং নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করুন। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনব। এমন হতে পারে যে আপনার যুক্তির কাছে আমি পরাভূত হয়ে গেছি এবং আমি আপনার অনুসারীও হয়ে যেতে পারি। কিন্তু তা না করে আপনি আমাকে বন্দী করতে চাইছেন কেন? আমাকে হত্যা করে ফেলতে চান কেন? আপনার মতো আমিও বেঁচে থাকতে চাই। আমারও তো রয়েছে সংসার, পিতা-মাতা, সন্তান, ভাইবোন, সমাজ আর রাষ্ট্র—যাঁদের প্রতি আমারও রয়েছে দায়, আছে ঋণ।

তবে বক্তব্যটা উপস্থাপন করতে হবে শালীন ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায়। বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলে তার জবাবটাও দিতে হবে একইভাবে। আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-প্রতিযুক্তি, থিসিস-অ্যান্টি থিসিস, বিতর্ক—এসবের অনুশীলন ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছাতে পারে না। এটি একটি প্রমাণিত সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ থেকে এই অনুশীলন যেন আজ অপস্রিয়মাণ।

লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী ও ভিন্নমতের মানুষ হত্যার মতো জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কি সংসদে কার্যকর আলোচনা হয়েছে? ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জন স্টুয়ার্ট মিল নামে একজন দার্শনিক ছিলেন, যিনি মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে দর্শন শাস্ত্রের এমন বিষয়ও পার্লামেন্টে উপস্থাপন করতেন। অন্য প্রতিনিধিরাও তাঁর কথা শুনতেন ও আলোচনায় অংশ নিতেন।

চার্লস ডিকেন্স যখন তাঁর অলিভার টুইয়িস্ট উপন্যাসে এক এতিম বালকের জীবনের করুণ কাহিনি বর্ণনা করলেন, তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ নিয়ে আলোচনা হলো। সেই বছরই অর্থাৎ ১৮৩৮ সালেই দরিদ্রদের সুরক্ষার জন্য আইন হলো। সারা পৃথিবীতেই তাঁর এ উপন্যাস ব্যাপকভাবে সাড়া জাগায়, মানুষের বিবেককে প্রবলভাবে আঘাত করে। উন্নত দেশগুলোতে এই যে বেকার ভাতার ব্যবস্থা, তার উৎস চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইয়িস্ট উপন্যাস। একজন লেখক কখনো কখনো সমগ্র মানবজাতির ওপরই সুদূরপ্রসারী ও শক্তিশালী অবদান রাখতে পারেন। অথচ একটি মহল প্রতিবাদী লেখককুলকে মেরে ফেলতে চাইছেন আর সংসদেও সে বিষয়ে নির্ভীক আলোচনা নেই, বিরোধী দলের প্রতিবাদ নেই।


মার্টিন লুথার কিং এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যে কথা আপনি ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছেন, শুধু সে কথার জন্যই আপনি দায়ী নন; যে কথা আপনি বলেননি, সে কথার জন্যও আপনি দায়ী।’ দক্ষিণ আফ্রিকার বিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেছেন, ‘ক্রান্তিকালে আপনার নীরবতার অর্থ হলো, আপনি শোষকের পক্ষে।’ আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলছেন:
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে।
...
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।।
অতএব, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে এবং প্রতিবাদ করতে হবে অন্যায় সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে—এক মুহূর্তও দেরি করে নয়। যদি না করি, এ অন্যায়ের জন্য আমিও দায়ী, আমিও শোষকের পক্ষের লোক বলে গণ্য হব।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected] <mailto: [email protected]>