কথা বলার, কথা না বলার গণতন্ত্র

সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতির হালচাল দেখে বহু বছর আগে প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেনের একটি কলামের শিরোনামের কথা মনে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন, ‘হরতাল হয়েছে, হরতাল হয়নি’। তখন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জমানা। বিরোধী দল হরতাল ডাকলেই সরকার তা বানচাল করতে নানা অপকৌশল নিত। পরদিন সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা জোর প্রচার চালাতেন, হরতাল হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে তিনি ওই বাক্যটি লিখেছিলেন। তখন হরতাল নিয়ে সরকারের ভয় ছিল। এখন ভয় সভা-সমাবেশ নিয়ে।

একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, তার মৌলনীতি কী হবে, সেসব সংবিধানে লেখা থাকে। আমাদের সংবিধানেও আছে। বিশেষ করে নাগরিকের মৌলিক অধিকার কোনো অবস্থাতেই খর্ব করা যায় না। শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশ করা ও মতপ্রকাশ করা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হইল।’

সম্প্রতি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতারাও শেষ ভরসা হিসেবে প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতকে বেছে নিয়েছেন। কেননা অন্য কোথাও সরকার সভা–সমাবেশ করতে দেয় না।

২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন সভা, সমাবেশ, গণজমায়েতের কর্মসূচির ঘোষণা দিচ্ছে। তাদের কর্মসূচি পালন করতে রাস্তায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় যান ও জন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। বিদ্যমান আইনে বৈধ কোনো দল বা গোষ্ঠীর সমাবেশের স্বাধীনতা থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে।

এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের নাগরিক সুবিধা অক্ষুণ্ন রাখা, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে এ ধরনের কর্মসূচি পালন এবং শব্দযন্ত্র ব্যবহারের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশ অনুসারে ডিএমপি কমিশনারের পূর্বানুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে একদিকে যেমন মিছিল বা সমাবেশকারী ব্যক্তিদের শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না; অপর দিকে কোনো কোনো দল বা গোষ্ঠী বেআইনি সমাবেশ আয়োজন করে জানমালের ক্ষতিসাধনসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করার সুযোগ পায়।

ঢাকা মহানগরীর নাগরিকদের জানমালের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো মিছিল, সভা-সমাবেশসহ কর্মসূচি গ্রহণ এবং শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করছে। অনুমতি ছাড়া কেউ এরূপ কার্যকলাপে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ডিএমপির এ বিজ্ঞপ্তি দেখে মনে হতে পারে, ২ ডিসেম্বরের আগে ঢাকা শহরে যে কেউ অবাধে সভা-সমাবেশ করতে পারতেন। হ্যাঁ, পারতেন। ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো চাইলেই যেকোনো স্থানে সভা-সমাবেশ করতে পারত। করোনাকালে সভা-সমাবেশ এমনিতেই কম। নিরুপায় মানুষ প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তাঁদের দাবি ও ক্ষোভের কথা জানান। শিক্ষকসহ কেউ কেউ সেখানে দাবি পূরণের জন্য অবস্থান ও অনশনও করেন। কখনো সরকার দয়াপরবশ হয়ে তাঁদের দাবি মেনে নেয়। কখনো শূন্য হাতেই তাঁরা ঘরে ফিরে যান।

সম্প্রতি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতারাও শেষ ভরসা হিসেবে প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতকে বেছে নিয়েছেন। কেননা অন্য কোথাও সরকার সভা–সমাবেশ করতে দেয় না। কয়েক দিন আগে প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির সমাবেশ থেকে ফেরার পথে পুলিশ বেশ কয়েকজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য অনেকবার ধরনা দিয়েও অনুমতি পায়নি। নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে দু-একবার অনুমতি মিলেছে। কিন্তু ডিএমপি বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না দিলেও একদা স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে। ডিএমপি হয়তো ভেবেছে, বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিলে তারা মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে দেবে। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায় প্রতিদিন বয়ান দিয়ে চলেছেন, বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই। যেই দলটির আন্দোলনের মুরোদ নেই, তারা মারাত্মক ঘটনা কীভাবে ঘটাবে?

ডিএমপির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা নতুন নয়। পুরোনো ফাইল ঘাঁটলে দেখা যাবে, বিএনপি, জাতীয় পার্টির আমলেও তারা একই ধরনের বিজ্ঞপ্তি দিত। এটি তাদের চাকরির শর্ত। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

প্রশ্ন হলো আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ জারি করার এখতিয়ার কার? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর না আদালতের? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রয়োগ করতে পারে। জননিরাপত্তা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তারা সমাবেশস্থলে প্রয়োজনমতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করতে পারেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে পারেন না।

সামরিক শাসনামলে জনগণের অনেক মৌলিক অধিকার খর্ব থাকতে দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলো সভা–সমাবেশ করতে পারত না। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন ঘটবে?

আমরা দেখেছি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ অফিসের চারপাশে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হতো, যাতে সেখানে কোনো সমাবেশ করতে না পারে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি অফিসের চারপাশে একই রকম পুলিশি পাহারা বহাল আছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টিতে বিরোধী দল মানেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং জননিরাপত্তার জন্য হুমকি।

যে রাষ্ট্র বিরোধী দলের প্রতি এ রকম বৈরী আচরণ করে, সে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সংহত হতে পারে না। ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলের ওপর যে আচরণ করে, বিরোধী দলও ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এসে একই রকম আচরণ করবে। ৪৯ বছর ধরে আমরা এ অবস্থা দেখে আসছি। ক্ষমতার মানুষ বদলায়, চরিত্র বদলায় না।

সামরিক শাসনামলে জনগণের অনেক মৌলিক অধিকার খর্ব থাকতে দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলো সভা–সমাবেশ করতে পারত না। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন ঘটবে? একই কায়দায় বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন চালানো হবে? তবে আমরা এ-ও মনে করি যে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রাজনীতিকদের রাস্তায় সমাবেশ ডেকে কথা বলার প্রয়োজন নেই। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত যেসব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম (বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বাসস, ডিএফপি ইত্যাদি) সেসব দলীয় বৃত্ত থেকে বের করে এনে জনগণের মাধ্যমে রূপ দিতে হবে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার বেতার-টিভিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করার উদ্দেশ্যে সাবেক সচিব আসাফউদ্দৌলার নেতৃত্বে একটি কমিশনও করেছিল। দুই যুগেও সেই কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলো না। সরকার কমিশনের প্রধানকে এখন ভিন্ন চিন্তার লোক মনে করতে পারে। কিন্তু ওই কমিশনের অনেক সদস্য ছিলেন, যাঁরা বরাবর আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনুসারী। তাঁরা কি ভুল সুপারিশ করেছিলেন?

ক্ষমতার রাজনীতি বরাবর জনজীবনের সমস্যা আড়াল করতে অপ্রয়োজনীয় ও অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে। সেসব নিয়ে কিছুদিন হইচই হয়। সময়ের ব্যবধানে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বিরোধী দলে থাকতে যাঁরা গণমানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার নিয়ে লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তোলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা পূর্বসূরিদের জুতোয় পা রাখেন। ফলে প্রতারিত ও বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। করোনাকালে জনগণের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা সেসব নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না। তঁারা দলীয় স্বার্থ ও দলীয় স্লোগানের বাইরে যেতে অভ্যস্ত নন। আগে মানুষ ক্ষমতাসীনদের প্রতি আস্থা হারালে বিরোধীদের ওপর ভরসা রাখত। কিন্তু এখন কারও ওপরই তারা ভরসা রাখতে পারছে না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]