কবে আমরা বিষয়গুলোর গভীরতা বুঝব?

বাজেটের আকার, প্রবৃদ্ধির হার, দৃশ্যমান উন্নয়ন ইত্যাদি বিচারে দেশের অগ্রগতির কথা স্বীকার করতেই হবে। এ ছাড়া গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার ইত্যাদি সূচকের উন্নতি দেশের অগ্রগতির বারতাই দেয়। কৃষি খাতে প্রায় সব ধরনের পণ্যেরই উত্পাদন বেড়েছে। এ যে অগ্রগতির গুরুত্ব অসীম, কেননা এ হলো জাতির এগিয়ে চলার ভিত। এই ভিত অর্থপূর্ণ এবং স্থায়িত্ব পাবে, যদি আমরা উন্নয়নের অন্যান্য দিকে সময়মতো নজর দিই। নয়তো এ উন্নয়ন টেকসই হবে না। কিন্তু এ বিষয়ে সময়োচিত উপলব্ধির ঘাটতি আছে বলেই মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কিছু কিছু কাজে এই উপলব্ধির ঘাটতিটা প্রকাশ পায়। তাতে সচেতন মানুষ হতাশা ও শঙ্কিত না হয়ে পারেন না।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধানের স্বাক্ষরে সরকারের সমর্থনে থিংকট্যাংক হিসেবে কাজ করার জন্য সাবেক সচিবদের একটি সভার কথা পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি। দুদকের চেয়ারম্যানের পদটি সাংবিধানিক পদ হওয়ায় তাঁকে যে শপথ নিতে হয়েছে, তাতে নিশ্চয় নিরপেক্ষতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত ছিল। তা ছাড়া, এটি সাধারণ জ্ঞান ও বিবেচনাতেই বোঝার কথা, যে দেশে দুর্নীতি প্রায় মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে এবং সবাই জানেন যে সরকারি খাতেই দুর্নীতির সিংহভাগ হয়ে থাকে, সেখানে খোদ দুদক চেয়ারম্যান যদি তাঁর পক্ষপাত জাহির করেন এবং তা লালনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চান, তাহলে সাধারণজনের বোকা বনা কিংবা অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে? সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশে হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এমন কাজের আগে নিজে পদটি ত্যাগ করতেন অথবা এমন কাজের দায় নিয়ে পদত্যাগ করতেন। কিন্তু এ দেশে এমন রেওয়াজ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

শিক্ষার বিস্তার, বিশেষত প্রাথমিকে প্রায় সব শিশুর অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষার সর্বস্তরে মেয়েদের অগ্রগতি বাংলাদেশের বুক ফুলিয়ে বলার মতো অর্জন। কিন্তু শিক্ষার মান? সব স্তরেই যে খুব শোচনীয়, তা সবারই জানা। পত্রিকান্তরে একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ও সচিব তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বাংলা, গণিত ও ইংরেজি জ্ঞানের করুণ অবস্থার কথা লিখেছেন। প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে সরকারি, বেসরকারি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের জরিপেই দেখা গেছে, ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মূল তিনটি বিষয়ে অভীষ্ট মান অর্জন করতে পারে না। সরকার এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত উন্নয়ন, শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, শ্রেণিকক্ষ, ভবনসহ ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন, গরিব ছাত্রদের জন্য দুপুরের খাবার প্রবর্তন, ছাত্রীবান্ধব টয়লেট ও পানীয় জলের ব্যবস্থা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রবর্তনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা থেকে উত্তরণ সহজ কিংবা সত্বর হওয়ার সম্ভাবনা কম। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পাবলিক পরীক্ষাটি বন্ধ করা না হলেও শেষ পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দিয়েছে সরকার।

কিন্তু তারপরও কীভাবে শিশুর লেখাপড়া এবং শারীরিক-মানসিক বিকাশ অব্যাহত রাখা সম্ভব, তা নিয়ে শিক্ষক মহলে ও স্কুল পর্যায়ে সঠিক ধারণা ও পরিকল্পনা নেই, ছিলও না। আজীবন পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার ছকের ভেতর কাজ করে অভ্যস্ত শিক্ষকেরা আকস্মিক এক ছক-ভাঙা বাস্তবতাকে কীভাবে কাজে লাগাবেন, তা জানেন না। এ ছাড়া এটাও পরিষ্কার নয় যে শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে এত দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এ–সংক্রান্ত বিভাগ-অধিদপ্তরগুলো মূলত পরীক্ষার ফলাফলকেই ভিত্তি ধরে এসেছেন, এখন কি তার বিকল্প কিছু হতে যাচ্ছে? যত দূর বুঝতে পারছি এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি রয়েছে। ফলে ষাণ্মাসিক-বার্ষিক পরীক্ষা উঠে গেছে বটে, কিন্তু তার বিকল্প হিসেবে মাসজুড়ে ক্লাস টেস্ট, বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষার বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে।

পরীক্ষা থেকে সরে আসার প্রাথমিক পদক্ষেপ হওয়া দরকার পিইসিই এবং জেএসসি পরীক্ষা দুটি বাতিল করা। তারপর শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিষয়ভিত্তিক এবং এর সঙ্গে যুক্ত সামাজিক জটিল বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করেই ধাপে ধাপে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। দুই শ বছর ধরে এ দেশে পরীক্ষা, মুখস্থবিদ্যা, প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাই চলে এসেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকেই জায়গির প্রথা ও টিউশনি চলে আসছে, নোট-গাইড বইও শতাব্দীপ্রাচীন অভ্যস্ততা। বলা যায়, এটি আমাদের প্রথম প্রজন্মের বিপুল শিক্ষার্থীতে ভারাক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাংস্কৃতিক অঙ্গ। যা সংস্কৃতি হিসেবে অভ্যস্ততায় পরিণত হয়, তার পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়, অন্তত সরকারি ঘোষণা বা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে পরিবর্তন আনা যে যায় না, তা বোঝা জরুরি। এর জন্য বাস্তব অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েই এগোতে হবে। নয়তো বড় পরীক্ষার স্থলে ছোট পরীক্ষার চাপ বাড়ার মতো নানা অঘটন ঘটে পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

দেখা যাচ্ছে বিষয়-নির্বিশেষে সবকিছুকেই উত্সব হিসেবে গ্রহণ ও পালন করার প্রবণতা কেবল বাড়ছেই। পরীক্ষা নাকি উত্সব, বইমেলা পেয়েছে প্রাণের উত্সব অভিধা। এতে প্রতিটি বিষয়ের গুরুত্ব যেমন লাঘব হয়, তেমনি গুরুত্ব অনুধাবনে আমাদের ব্যর্থতা বা অমনোযোগিতা প্রমাণ করে। ফলে পরীক্ষায় ভালো মান অর্জন করেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানের স্তর অনুযায়ী ন্যূনতম মানও অর্জিত হচ্ছে না। এদিকে দেখা যাচ্ছে বইমেলাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হলেও মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা নিতান্ত কম, তা ছাড়া, এত দিনেও প্রকাশকেরা বইয়ের বিষয়বস্তুর রচনা, সামগ্রিক পাণ্ডুলিপির সংগতিপূর্ণ বিন্যাস, কিংবা ভাষাগত মান যাচাইয়ের মতো সম্পাদনায় মনোযোগী নন। সর্বোপরি আইন থাকা সত্ত্বেও দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো প্রকাশনা সংস্থাই লেখকদের সঙ্গে সম্মানজনক কোনো চুক্তি সম্পাদনের তোয়াক্কাই করেন না। ছেলেমানুষি আবেগ আর উচ্ছ্বাস দিয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা সফল হতে পারে না।

যদি আমরা অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে তাকাই তাহলে দেখব এর ভিত্তি মজবুত হয়নি। দেশের ব্যাংক খাত যে নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে, তা সবাই স্বীকার করেন। এ খাতে বড় বড় অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা সবাই জানেন। বিনিয়োগের জন্য পুঁজি সংগ্রহের শক্তিশালী ব্যবস্থা নেই। ফলে বিনিয়োগ স্তিমিত, কর্মসংস্থান খুবই মন্থর। সবল অর্থনীতি বেকার তৈরি করে না, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ায় না, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না, বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় না। আমাদের অর্থনীতির এসব নেতিবাচক প্রবণতা তার দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।

গণতন্ত্র আছে কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, সংসদে ‘নির্বাচিত’ আইনপ্রণেতারা দেশের স্বার্থ, জনগুরুত্বসম্পন্ন ইস্যু ও নীতি-আইনের চর্চার পরিবর্তে স্তাবকতা ও তিরস্কারেই সময় ব্যয় করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হচ্ছে, ক্ষমতা সরকারের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে আর সরকার একক নেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন, সংসদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন সবল অবস্থান ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নীতি-আদর্শের দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে কি না, সে বিষয়টি খোলাসা না করে দেশ ও গণতন্ত্রের প্রতি অবিচার করছে। বাংলাদেশ একটি আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতেই বহু সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ফলে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির স্থান তো এ দেশে হতে পারে না।

এই সূত্রেই বলতে হবে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের আদর্শ ও চেতনার কথা তো সবাইকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। বিএনপির জন্য তা যেমন সত্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য তা আরও বড় সত্য। সেই বিচারে প্রশ্ন তুলতেই হবে—সরকার কি ঠিক পথেই আছে? আর মুজিব বর্ষের যে অনুষ্ঠানগুলো জাতীয় কমিটি এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আয়োজিত হচ্ছে, তার মানও কি উপলক্ষের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকছে?

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক