কমিউনিস্টরা কি বার্লিন দখল করবে!

বার্লিনে বুন্ডেস্টাগ ভবনের সামনে কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় পতাকা

শেষ মুহূর্তে এসে জার্মান নির্বাচনী রাজনীতির রং বদলে গেছে। কয়েক মাসে আগেও মধ্য ডান খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক দল (সিডিইউ) জনমত জরিপে এগিয়ে ছিল। সবুজ দলের সঙ্গে সরকার গঠনের আলাপও উঠেছিল দুই দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। সবুজ দল ঠিক করেই রেখেছিল, সিডিইউর সঙ্গে যদি জোট করতেই হয়, তবে তাদের দাবি থাকবে চ্যান্সেলর পদ নিয়ে। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে জনমত এবার সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের (এসডিপি) দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে।

এখন মধ্য বাম এসডিপি, সবুজ দল ও বাম দলের জোট মানে লাল-লাল-সবুজদের সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। বিশ্লেষকেরা সম্ভাব্য এই জোটকে বলছেন রেড টু গ্রিন সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকার বাদ দিলে এই প্রথম জার্মানিতে বামপন্থীরা সরকারের অংশীদার হতে পারে।

নির্বাচনী প্রচারণার একেবারে শেষ দিকে এসে জনমতের পরিবর্তন ক্ষমতাসীন সিডিইউকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ অবস্থায় শুধু বাম দল নয়, এসডিপি ও সবুজ দলকেও সিডিইউর সমর্থকেরা বামপন্থীদের কাতারে ফেলে দিয়েছেন। সিডিইউর সমর্থকেরা মূলত এখন বাম দলকে লক্ষ্য করেই নির্বাচনী তির ছুড়ছেন। নির্বাচনী সভা-সমাবেশগুলোতে সিডিইউর মূল বক্তব্য হচ্ছে, কমিউনিস্টরা বার্লিন দখল করতে আসছে। সিডিইউ নেতা ও চ্যান্সেলর প্রার্থী আরমিন লাশেট গত বৃহস্পতিবার হামবুর্গে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বলেছেন, জার্মানিতে বামপন্থী সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জন্য সরাসরি হুমকি। তিনি ওই বক্তব্যে উল্লেখ করেন, বামপন্থীরা ইউরোপের ঐক্যের পথে বাধা। তারা ইইউ গঠনে লিসবন, মাস্ট্রিক্ট, নিস চুক্তিসহ মুক্ত অর্থনীতির কমন মার্কেট গঠনের পথে বাধা দিয়েছে। এমনকি সম্প্রতি আফগানিস্তানে উদ্ধারকারী দল পাঠাতেও বাধা দিয়েছেন বাম দলের সংসদ সদস্যরা। বামদের সঙ্গে সরকার গঠনের সম্ভাবনা বাতিল না করায় এসডিপির প্রার্থী ওলাফ শোলজেরও সমালোচনা করেন লাশেট।

কিছুটা বিলম্বে হলেও সিডিইউর বামবিরোধী মিছিলে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যারকেলও যোগ দিয়েছেন এবং এসপিডির দিকে ঝুঁকে থাকা অংশকে বাম ধারা চিহ্নিত করে নিজ দলের সমর্থকদের সতর্ক করে দিয়েছেন। সিডিইউর ভোটারদের কোমর বেঁধে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ভোটারদের যথাযথভাবে দলে টানতে না পারলে বার্লিনের বুন্ডেস্টাগ এবার বামপন্থী কমিউনিস্টরা দখলে নেবে।

ঠিক যেন হুট করেই জার্মানির নির্বাচনী বাতাস ভিন্ন দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। জুলাই পর্যন্ত জনমত জরিপে সিডিইউ ২৯ শতাংশ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে ছিল। ১৯ শতাংশ জনমত নিয়ে সবুজ দল দ্বিতীয় স্থানে ছিল। আর এসডিপি তৃতীয় স্থানে ছিল ১৫ শতাংশ সমর্থন নিয়ে। কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে এসে এসডিপির প্রতি জনসমর্থন ঝুঁকতে শুরু করে। সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে এসডিপি ২৫ ভাগ সমর্থন নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। সিডিইউ ২১ শতাংশ সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে নেমে গেছে। আর সবুজ দলের প্রতি এই মুহূর্তে ১৬ শতাংশ ভোটার সমর্থন করছে।

যদি আবারও ভোটারদের মন ঘুরে যায় এবং সিডিইউ নির্বাচনে জিতে গেলে এসডিপিকে নিয়েই সরকার গঠন করবে। কিন্তু ২৬ সেপ্টেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত ভোটারদের বর্তমান মনোভাব বজায় থাকলে এসডিপির নেতৃত্বে জোট সরকার গঠিত হবে। এসডিপির সঙ্গে সবুজ দল থাকবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য তৃতীয় একটি দলের সমর্থন লাগবে। মুক্ত গণতান্ত্রিক দল (এফডিপি) বরাবরই ১০ থেকে ১১ শতাংশ পায়। এবারও তাদের ভোট প্রাপ্তিতে খুব বেশি হেরফের হবে না। এফডিপিও লাল-সবুজের জোটকে সমর্থন করতে প্রস্তুত। তবে শর্ত হচ্ছে তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। এফডিপি বাজার অর্থনীতির কট্টর সমর্থক ও চরম উদারীকরণের পক্ষে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সেবা খাতে বেসরকারি উদ্যোগের অধিক অংশীদারত্বের পক্ষে। এসবের পাশাপাশি করপোরেট কর ও উচ্চ আয়ের ওপর কর হ্রাসের অন্যতম প্রচারক। এফডিপির শর্ত মেনে নিয়ে এসডিপি ও সবুজ দলের পক্ষে সরকার পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

এফডিপির শর্ত মেনে না নিলে বিকল্প থাকে বাম দল। বাম দলের ৭-৮ ভাগ ভোট রয়েছে। বাম দলের সমর্থন নিয়ে এসডিপি ও সবুজ দল সরকার গঠন করতে পারে। নির্বাচনী ইশতেহারও মোটামুটি একই ধরনের এই তিন দলের। তিনটি দলই করপোরেট করসহ উচ্চ আয়ের ওপর অধিক হারে কর ধার্যের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর সঙ্গে শ্রমিকসহ মধ্য আয়ের নাগরিকদের বেতন কমপক্ষে ঘণ্টায় ১২ ইউরো করার প্রস্তাব দিয়েছে। শ্রমের ঘাটতি মিটাতে তিন দলই অভিবাসনের পক্ষে।

অভিবাসনপ্রক্রিয়া আরম্ভ সহজ করার জন্য অনেক দিন ধরেই এই তিন দল কথা বলছে। পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষায় আরও দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে এসডিপি, সবুজ দল ও বামপন্থীরা।

নীতিগত অনেক বিষয়ে মতৈক্য থাকলেও বাম দল নিয়ে সরকার গঠন ও পরিচালনা করাও এসডিপির নেতা ওলাফ শোলজের পক্ষে সহজ হবে না। অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে বাম দলের সঙ্গে খুব বেশি দ্বিমত না হলেও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। সাবেক পশ্চিম জার্মানির বাম ঘরানার ও পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকদের নিয়ে গড়া দল ডি লিংকে বা বাম দল সব সময়ই ন্যাটোর কড়া সমালোচক। ন্যাটোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অভিযানেরও বিপক্ষে বামপন্থীরা। এমনকি বামদের অনেকেই মনে করেন, ন্যাটো জোট থেকে বের হয়ে জার্মানির উচিত রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তবে বামপন্থী নেতারা মনে করছেন, এসব বিষয় এসডিপির সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি প্রশ্নে বাধা হবে না। উদারপন্থী দল হিসেবে এসডিপিও রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী।

বোঝাই যাচ্ছে, নির্বাচনে জয়ী হলেও এসডিপি নেতা ওলাফ শোলজকে এক কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে। ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত মুক্ত গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সরকার গঠন করলে চরম পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির সরকার হবে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে। আবার বামপন্থীদের নিয়ে সরকার গঠন করলে জার্মান সমাজের বিভাজন আরও প্রকট আকার ধারণ করার শঙ্কা রয়েছে। উদারপন্থী ও কট্টর রক্ষণশীলদের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়তে পারে। বিগত সময়ে রক্ষণশীল সিডিইউ আর উদারপন্থী এসডিপি মিলে কয়েক দফায় সরকার গঠন করায় সমাজে কট্টর ও উদারপন্থীদের বিভাজন খুব স্পষ্ট ছিল না। এ ছাড়া আঙ্গেলা ম্যারকেলও দুই শিবিরে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। কট্টরপন্থী ও উদারপন্থীদের তিনি এক সুতায় গাঁথতে সমর্থ হয়েছিলেন।

কিন্তু ম্যারকেল-পরবর্তী যুগে এ ধরনের সহমতের অবস্থা না-ও থাকতে পারে। ওলাফ শোলজ উভয় পক্ষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবেন, সেটাও দেখার বিষয়। যদি দক্ষতার সঙ্গে রাজনীতি পরিচালনা করতে পারেন শুলজ, তবে তিনি ম্যারকেলকে ছাড়িয়ে যাবেন। আর না পারলে লোকরঞ্জনবাদীদের চরম উত্থান খুব দ্রুতই ঘটতে পারে। এসডিপির সঙ্গে একাধিকবার সরকার গঠন, সিরীয় অভিবাসীদের ঠাঁই দেওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া, পরমাণু শক্তির ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার কারণে দলের মধ্যেই ম্যারকেল চরম সমালোচনা রয়েছে। যারা অত্যন্ত কট্টর বলে পরিচিত। আর এবারের নির্বাচনে সিডিইউ হেরে গেলে চরম রক্ষণশীল এই অংশ লোকরঞ্জনবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচলান্ড বা বিকল্প দলের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক