কর কমিয়ে লাভ নেই

জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনিক প্রতাপশালী ব্যক্তিরা দেশটির প্রধান সমস্যা (অসমতা, নিম্ন প্রবৃদ্ধি, নিম্ন উৎপাদনশীলতা, বিদ্যালয়ের নিম্ন মান, ক্ষয়িষ্ণু অবকাঠামো) কোনটা, তা নিয়ে একমত হতে না পারলেও সমাধান সব সময় একই রকম আসে। সেটা হলো নিম্ন কর হার, নিয়মকানুন শিথিল, বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা দেওয়া ও অর্থনীতিকে ‘মুক্ত’ করে দেওয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও মহান বানানোর চেষ্টা করছেন।

এটা কখনো হবে না। কারণ, এটা কখনো ছিল না। দেশটির প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যখন ১৯৮০-এর দশকে এটা করার চেষ্টা করেন, তখন তিনি দাবি করেছিলেন, কর রাজস্ব বাড়বে। এর বদলে দেখা গেল, প্রবৃদ্ধির হার এবং কর আহরণ কমে গেল। এতে শ্রমিকদের কষ্ট বাড়ল। আপেক্ষিকভাবে বড় দান মারল করপোরেট ও ধনীরা। করের হার নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় তারা লাভবান হয়।

ট্রাম্প এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কর হার প্রস্তাব করেননি। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তিনি যা করতে গেলেন তাতে স্বচ্ছতার অভাব ছিল, কিন্তু এবার সেই কায়দায় লাভ হবে না। বর্তমান প্রস্তাবে ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যবিমা হারাতে পারেন, তাঁরা জানেন না, সামনে কী আসতে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্পের কর সংস্কারে কোম্পানিগুলো কতটা লাভবান হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা নেই।

ট্রাম্প এখানেই উভয়সংকটে পড়েছেন। তাঁর কর সংস্কার রাজস্বনিরপেক্ষ হতে হবে। এটা রাজনৈতিকভাবে অত্যাবশ্যকীয়। করপোরেশনগুলো হাজার হাজার কোটি ডলারের ওপর বসে আছে, যেখানে সাধারণ মার্কিন নাগরিকেরা কষ্ট করছেন। গড় করপোরেট কর হার কমানোটা গ্রহণযোগ্য হবে না, বিশেষ করে আর্থিক খাতের জন্য, যাদের কারণে ২০০৮ সালে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়, যারা তার দায় কখনো পরিশোধ করেনি। এ ছাড়া সিনেটের প্রক্রিয়া অনুসারে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কর সংস্কার করতে হলে তাকে ১০ বছর বাজেট নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কারণ, ডেমোক্র্যাটরা এর তীব্র বিরোধিতা করবে, প্রয়োজনীয় তিন-পঞ্চমাংশ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া করতে গেলে এমনটা করতে হবে।

এর মানে গড় করপোরেট কর হার একই রকম রাখতে হবে, যার মানে হলো এতে যেমন অনেকে লাভবান হবে, তেমনি অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাউকে এখনকার চেয়ে কম ব্যয় করতে হবে, কাউকে বেশি। ব্যক্তি করের ক্ষেত্রে অনেকে এ থেকে ছাড় পেতে পারেন। কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এটা খেয়াল করলেও তারা যথেষ্ট সংগঠিত নয়। এর বিপরীতে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কংগ্রেসে লবি করে থাকে।

অনেক অর্থনীতিবিদই স্বীকার করবেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান করকাঠামো অদক্ষ ও অন্যায্য। কিছু প্রতিষ্ঠানকে অন্যদের চেয়ে বেশি কর দিতে হয়। সম্ভবত উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানগুলো যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, তাদের অংশত কর ছাড় দিয়ে পুরস্কৃত করা উচিত।

সবচেয়ে গুরুতর সমস্যার একটি হলো মার্কিন করপোরেশনগুলোর বৈদেশিক উপার্জনের ওপর রাজস্ব। ডেমোক্র্যাটরা বিশ্বাস করে, মার্কিন কোম্পানিগুলো যেখানেই কাজ করুক না কেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসনের কারণে লাভবান হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের এটা নিশ্চিত করার ক্ষমতা আছে যে তাদের সঙ্গে যেন অন্যায় আচরণ করা না হয়। কখনো কখনো এটা নিশ্চিত করতে চুক্তি পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এসব কোম্পানির মধ্যে ন্যায্যতা ও পারস্পরিক উপকারের বোধ বেশি শক্তিশালী নয়, জাতীয় আনুগত্যের বোধ আরও কম। সে কারণে তারা সদর দপ্তর অন্যত্র স্থানান্তরের হুমকি দেয়।

এ হুমকির ব্যাপারে সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে রিপাবলিকানরা অংশত ভৌগোলিক করব্যবস্থার কথা বলে থাকে, অধিকাংশ দেশেই যা অনুসৃত হয়। অর্থাৎ যে দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংগঠিত হয়, সে দেশেই কেবল তা আরোপ করা উচিত। এর কারণ হলো মার্কিন কোম্পানির বিদেশে অর্জিত মুনাফার (কর দেওয়া হয়নি এমন) একবার শুল্ক আরোপ করার পর এই ভৌগোলিক ব্যবস্থা আরোপ করা হলে করের পরিমাণ কমে আসবে।

এটা দূর করতে মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার পল রায়ান নেট আমদানির ওপর করারোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে কর্মসংস্থান কমে যায়, তাই এটা নিরুৎসাহিত করা উচিত। একই সময়ে নেট আমদানি এখনকার মতো বেশি হলে এই করারোপ করে ব্যাপক রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব। কিন্তু এখানেই জটিলতা, সেটা হলো টাকাটা তো একজনের পকেট থেকে আসতে হবে। আমদানির মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে চীনের কম দামি কাপড়ের ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ট্রাম্পের দলের কাছে এটি পরোক্ষ ক্ষতি, ব্যাপারটা হলো কী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতাপশালী ধনিকদের থলে আরও ভরাতে এই অনিবার্য মূল্যটা কাউকে দিতেই হবে। কিন্তু শুধু ভোক্তা নয়, ওয়ালমার্টের মতো খুচরা বিক্রেতারাও এই পরোক্ষ ক্ষতির শিকার হবে। ওয়ালমার্ট এটা জানে, তাই তারা সেটা হতে দেবে না।

অন্যান্য করপোরেট কর সংস্কারের অর্থ থাকতে পারে। কিন্তু সেখানেও কেউ দান মারবে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা যত বাড়বে এবং তারা সংগঠিত থাকবে, তত দিন এই সংস্কার বন্ধ করার সক্ষমতা তাদের থাকবে।

রাজনৈতিকভাবে চৌকস নেতা, অর্থাৎ যিনি করপোরেট কর সংস্কারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অর্থ গভীরভাবে বোঝেন, তিনি কংগ্রেসকে অর্থবহ সংস্কারের দিকে ধাবিত করতে পারতেন। কিন্তু ট্রাম্প সে রকম নেতা নন। আর করপোরেট কর সংস্কার আদৌ যদি হয়, তাহলে ব্যাপারটা হবে বন্ধ দরজার ভেতরে জগাখিচুড়ির মতো। তবে সব পর্যায়ে কিছু কিছু করে কর হ্রাসের সম্ভাবনাই বেশি। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজকের লোভী ক্ষমতাবানেরা লবি করে তাদের অন্ধকারে ঠেলে দেবে। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে লোভী হচ্ছে জুয়াড়িরা। এর এসব নোংরামি গা সওয়া করতে এক পুরোনো যুক্তি দেওয়া হবে। অর্থাৎ কর হার কমানো হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এই কথার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভিত্তি নেই। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, যেখানে বেশির ভাগ বিনিয়োগ হয় ঋণের টাকায় এবং সুদ থেকে কর কাটা যায়। অতিরিক্ত লাভ ও অতিরিক্ত খরচ উভয়ই আনুপাতিক হারে কমানো হয়, ফলে বিনিয়োগ মূলত অপরিবর্তিত থাকে।

যে দেশে অসমতাসহ হাজারো সমস্যা রয়েছে, সেখানে কর হার কমানো কোনো সমস্যারই সমাধান দেবে না। যেসব দেশ কর ছাড়ের কথা ভাবছে, তাদের জন্য এটা শিক্ষা। এমনকি যে দেশ অনভিজ্ঞ ও ভীরু প্রতাপশালী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাদের জন্যও এটি সত্য।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।