করোনা মারি শেষ হবে কবে

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি কবে শেষ হবে? এই প্রশ্ন আজ ভীষণ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। রোজ খবর পাই, প্রিয় পরিচিত মানুষেরা চলে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির দুই চেয়ারম্যান—আনিসুজ্জামান ও শামসুজ্জামান খানকে হারালাম। কবরীর মতো গুণী প্রিয় মানুষ এত অল্প বয়সে চলে যাবেন? মিতা হক, তবিবুল ইসলাম বাবু, এস এম মোহসিন—একেকটা দুঃসংবাদ আসে, আর মনে হয় হৃদয়টাই গোরস্তান হয়ে গেল। প্রথম আলো তার কলাম লেখক কতজনকে হারাল, মিজানুর রহমান খান, সৈয়দ আবুল মকসুদ...এখন শুধু শোক আর শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখতেই দিন যাচ্ছে।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের প্রকোপের তীব্রতম আঘাতের মধ্যে আছে। আমরা ২০২০ সালে কখনোই দৈনিক মৃত্যু এক শর কাছাকাছি উঠতে দেখিনি, টেস্টের মধ্যে করোনা পজিটিভ পাওয়ার হার একটা সীমার মধ্যে ছিল। ২০২১ সালে এসে দেখা গেল, মৃত্যু এক শ অতিক্রম করেছে, টেস্টে করোনা পজিটিভের হার আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশে কোভিড রোগী প্রথম পাওয়া যায় ২০২০-এর মার্চে, তারপর থেকে অনেকেই বলে আসছিলেন যে এই বিশ্বমারি শিগগির চলে যাবে না, তা আমরা শুনতাম বটে। কিন্তু মনে মনে আশা করতাম, ২০২১ সালে টিকা চলে এলে এর প্রকোপ কমে যেতে বাধ্য।

এখন সেই বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, করোনার মহাবিপদ পৃথিবী থেকে দূর হবে কবে? বাংলাদেশ থেকে যাবে কবে?

ম্যাকিনসি ডট কম এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গত মার্চে। গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদন। তারা বলছে, যুক্তরাজ্যে ২০২১-এর মাঝামাঝি পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হবে এবং জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা তাদের স্বাধীনতা দিবস ৪ জুলাই অনেকটাই মুক্ত পরিবেশে পালন করতে পারবে।

এই আশার মূলে হলো টিকা। টিকাদান চলছে, মানুষ টিকা গ্রহণ করছে এবং তারা মোটামুটি টিকা দিয়ে হার্ড ইমিউনিটিতে চলে আসবে। এইখানেই এই প্রশ্নটা আসে যে টিকা কি কার্যকর? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা উদ্ধৃত করব সিডনি মর্নিং হেরাল্ড থেকে। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে সায়েন্স জার্নাল থেকে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন—সব টিকাই ৯৫ থেকে ১০০ ভাগ কার্যকর। সুতরাং যেকোনো টিকা, যেটা পাওয়া যাবে, সেটা পূর্ণ ডোজে সবাইকে দিলেই কেবল আমরা এই বৈশ্বিক মহামারি থেকে রক্ষা পাব।

একটা অঙ্ক করি। ধরা যাক, একটা দেশে ১০০০ জন মানুষ আছেন। তাঁরা যদি কোনো টিকা না দিই এবং কোনো সাবধানতা অবলম্বন না করি, তাহলে তাঁদের ৭৫০ জন আক্রান্ত হতে পারেন। (কোনো মহামারিতেই সবাই আক্রান্ত হননি এই পৃথিবীতে।) এঁদের মধ্যে ৪০০ জন জানবেন না যে তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন। ৩৫০ জনের মধ্যে ৩০০ জন ভুগবেন। ৫০ জনকে হাসপাতালে যেতে হবে। এঁদের মধ্যে ৬ জন মারা যেতে পারেন। কিন্তু যদি তাঁরা টিকা নেন, তাহলে ৫০ জন আক্রান্ত হবেন। এঁদের মধ্যে ৮ জনকে হাসপাতালে নিতে হবে। আক্রান্তের ২ শতাংশ মারা যান হিসাব করলে পরিসংখ্যান অনুসারে কেউই মারা যাবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, আর সংক্রমণের ভয় আপাতত থাকবে না।

কাজেই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে এখন টিকা আনা এবং টিকা দেওয়ায়। আমরা টিকা সমস্যার বাস্তব পরিস্থিতি জানি। পৃথিবীতে টিকা রাজনীতি হচ্ছে, টিকা কূটনীতি হচ্ছে। আমরা প্রথম দিকে ভারতে প্রস্তুত সেরামের টিকা পেয়েছি। কিনে এনেছি, উপহার হিসেবেও পেয়েছি। কিন্তু এখন ভারতের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ওখানে টিকা পেয়েছে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ। ফলে শুধু বাংলাদেশকে নয়, অন্য দেশেও টিকা পাঠানো ভারত সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা বলছি, বড় ভুল হয়ে গেছে, আমাদের এক দেশের ওপর নির্ভর করা উচিত হয়নি, আরও আরও দরজা খোলা রাখা উচিত ছিল, নিজেদের উৎপাদনে যাওয়া উচিত ছিল ইত্যাদি। এই সমালোচনার যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ না করে বলা যায়, এখন তাহলে আমাদের কর্তব্য কী। আমাদের অন্তত ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। এখনো বহু পথ বাকি। তারপর উন্নত দেশে আচরিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, যদি পূর্ণবয়স্ক সবাইকে টিকা দেওয়ার নীতি আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া নেয়; আমরাও তাই করব, এই প্রস্তুতি আমাদের নিতে হবে।

মাঝেমধ্যে কাগজে সুখবরও পাওয়া যায়। ফাইজার নাকি কোভিডের মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশন বের করে ফেলার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

আমাদের সাম্প্রতিক লকডাউন কিন্তু সুফল দিয়েছে। আমরা যদি সত্যি সত্যি কার্যকর লকডাউন করতে

পারতাম ২১ দিন, তাতে পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি সম্ভব ছিল। কিন্তু এই দেশের সামাজিক–অর্থনৈতিক–সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় কোনো লকডাউনই আমরা ১০০ ভাগ কঠোরতার সঙ্গে করতে পারি না। আবার গরিব মানুষকে তাদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দিতে হবে। দেশের অর্থনীতি যাতে ভেঙে না পড়ে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। অনির্দিষ্টকাল লকডাউনের চেয়ে টিকা আনা এবং দেওয়ার খরচ কম, তার লক্ষ্য অর্জন করা অধিকতর বাস্তব। কাজেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা বা অর্জন করা, হাসপাতালের বেড, চিকিৎসা, অক্সিজেন, ওষুধ, ডাক্তার, নার্স ইত্যাদির সংস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হলো টিকা দেওয়া। সর্বজনীন টিকাদানের কর্মসূচিতে অতীতে বাংলাদেশ খুব ভালো করেছে, এসব ব্যাপারে দেশের মানুষ সহযোগিতা করতে সব সময় প্রস্তুত। এ পর্যন্ত যা টিকা পাওয়া গেছে, তা দেওয়ার সময়ের শৃঙ্খলা সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। মে থেকে রাশিয়ার টিকা পাওয়া গেলে, পরবর্তীকালে অন্য উৎসগুলো ব্যবহার করতে পারলে এবং দেশে টিকা উৎপাদন করা গেলে আমরা এই টিকার সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। আমাদেরও একটা টার্গেট করতে হবে যে আমরা জুন–জুলাই–আগস্ট পর্যন্ত মোট কতজনকে টিকা দিতে চাই। যদি আমরা ঢাকা শহরের চল্লিশোর্ধ্ব সবাইকে টিকা দিতে পারি, তাহলেও সেটা একটা বড় অগ্রগতির সূচনা করবে।

এই লেখা শুরু করেছিলাম এই প্রশ্ন দিয়ে: আমরা কবে করোনা অতিমারির ভয় থেকে বেরিয়ে আগের মতো বা প্রায় আগের মতো করে চলতে পারব। এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আমেরিকা–ব্রিটেন এটা পারবে এই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে। আমরা যদি টিকা আনতে পারি এবং ব্যাপকভাবে টিকা দিতে পারি, তাহলেই কেবল তা পারব। আমরা যদি এই বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে তা করতে চাই, তাহলে কত টিকা দরকার এবং কত উচ্চ হারে টিকা দেওয়া দরকার, তা আশা করি নীতিনির্ধারকেরা বুঝছেন। প্রতি মাসে আমাদের এক কোটি মানুষকে ইমিউনাইজ করতে হবে। বিশাল কর্মযজ্ঞ! আশা করি নীতিনির্ধারকেরা ব্যাপারটার বিশালতা এবং জরুরত

বুঝতে পারছেন।

বস্টন বিজনেস জার্নাল–এ প্রকাশিত ম্যাকিনসির জ্যেষ্ঠ পার্টনার নভোজাত সিংয়ের রচনা ‘করোনার পরবর্তী যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারি’ (ফেব্রুয়ারি ২০২১) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি।

‍‘নভেল করোনাভাইরাসের তীব্রতা সবচেয়ে বড় আশাবাদীর আত্মবিশ্বাসকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা কী তুলনারহিত অগ্রগতি অর্জন করেছি। আমরা বিপদের চূড়া থেকে

নেমে এসেছি। খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যুর হার কমে আসবে, মানুষ আস্থা ফিরে পাবে। তারা স্বাভাবিক রুটিন কাজে নেমে পড়বে। ব্যবসায়িক নেতারা সেই দিনের জন্য দিনপঞ্জিতে দাগ কেটে পরিকল্পনা করতে পারেন। এখানে বস্টনে আমাদের কাজ হবে টিকা যাতে সবাই নিতে উৎসাহিত হন তা নিশ্চিত করা, আর স্থানীয় অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করা।’

বস্টনের প্রেক্ষাপট আর আমাদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত নয়। কিন্তু একটা বিষয়ে বস্টনের চেয়ে ঢাকা এগিয়ে। মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী

আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শত বাধার মুখেও চালিয়ে যাচ্ছে। এই কালো রাত শেষ আমাদের এখানেও হবে এবং তাড়াতাড়িই হবে।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক