করোনা-পরবর্তী খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতে যা করতে হবে

করোনা-পরবর্তী জীবনমান ধরে রাখতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহের চেইন ঠিক রাখা কঠিন হতে পারে। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি কী হতে পারে, এ নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসচেতন হওয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন ও পুষ্টি নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। কোনো সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের সারা বছর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তির শারীরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিদ্যমান থাকলে তবেই সেই সমাজে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে বলা যাবে।

গত বছর বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ (৮১ কোটি ১০ লাখ) মানুষ অপুষ্টিতে ভুগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা মহামারি অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। অপুষ্টির শিকার মানুষের অর্ধেকের বেশি (৪১ কোটি ৮ লাখ) এশিয়ায় এবং এক-তৃতীয়াংশের বেশি (২৮ কোটি ২০ লাখ) আফ্রিকায় বসবাস করে।

খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান শর্ত কৃষির (খাদ্যশস্য, পশুপাখি ও মাছ) উৎপাদন ও খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৬ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছে, যা বিশ্বে চতুর্থ। গত বছর রেকর্ড ১০২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যেটা আগের বছরে ছিল ৯৪ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। অন্যান্য সবজি উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৩ লাখ মেট্রিক টন। এক বছরে সবজির উৎপাদন ১০ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন বা ৮ শতাংশ বেড়েছে (বিবিএস)। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়।

এফএওর হিসাব মতে, গত ৪৫ বছরে সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ হারে। গত অর্থবছরে ৮৩৪ কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হয়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল ৬৮৭ গ্রাম। খাদ্যের অন্যতম উপাদান আমিষ, যা মাংস, ডিম, দুধ (সুপার ফুড) থেকে আসে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদার ৫৭ দশমিক ৭২ শতাংশ জোগান দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ খাত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারা দেশে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৭৩২ কোটি ৬৪ লাখ (বার্ষিক জনপ্রতি চাহিদা ১০৪টি ডিম ধরে)। কিন্তু দেশে উৎপাদিত ডিমের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৩৬ কোটি, যা চাহিদার চেয়ে বেশি। দৈনিক মাথাপিছু মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রাম ধরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাংসের চাহিদা ছিল ৭২ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন আর উৎপাদিত মাংসের পরিমাণ ছিল ৭৬ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ফলে দৈনিক মাথাপিছু মাংসের প্রাপ্যতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৬ দশমিক ২০ গ্রাম। মাংস ও ডিম উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।

কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি সুন্দর বিপণনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে সরাসরি কৃষক থেকে সরাসরি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুধের চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার মেট্রিক টন (জনপ্রতি দৈনিক চাহিদা ২৫০ মিলি ধরে), কিন্তু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। ফলে দুধের দৈনিক মাথাপিছু প্রাপ্যতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫ দশমিক ৬৩ মিলি। পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষের আরেকটি বড় উৎস মৎস্য খাত। পুষ্টিগত দিক বিবেচনায় মাছ অন্যতম নিরাপদ আমিষ। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ৪৫ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে পৃথিবীতে বার্ষিক মাথাপিছু মাছ খাওয়ার গড় হার ছিল ২০ দশমিক ৫ কেজি, সেখানে বাংলাদেশে এ হার ছিল ২৩ কেজি। আমাদের মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির ধারা ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা বিশ্বের মূল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ।

খাদ্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে গেলেও খাদ্যনিরাপত্তা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে আমাদের করণীয় সম্বন্ধে আলোকপাত করা যাক।

খামার পর্যায়ে: নতুন উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রযুক্তি, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা, ক্রপজোনিং, জৈবপ্রযুক্তি, লেজারপ্রযুক্তি, আধুনিক সেচব্যবস্থা, মাটি পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন গড়ে তোলার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। প্রতি ইঞ্চি জমি ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পরিমাণে খাদ্যশস্য, গবাদিপশু ও মাছ উৎপাদন করা।

ভোক্তা পর্যায়ে: দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন মাছ, মাংস, দুধ, ডিম খাওয়ার পাশাপাশি ভোক্তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা। উদাহরণস্বরূপ ভাতের মাড় না ফেলে মাড়সহ ভাত রান্না করা। যেকোনোভাবেই হোক প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ তাজা শাকসবজি-ফলমূল খাওয়া। তরকারি কাটার সময় কিংবা ফল খাওয়ার সময় বাকল বা চামড়া না ফেলে ভালোভাবে পরিষ্কার করে খাওয়া। রান্নার সময় স্বাস্থ্যসম্মত অনুপাতে বিভিন্ন মসলা, যেমন কালিজিরা, রসুন, পেঁয়াজ, মৌরি, ধনে যোগ করা।

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে: গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ—খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি মাথায় রেখে এ খাতের বিকাশে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন সহজ শর্তে খামারিদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্যোক্তাদের কর অব্যাহতির সুযোগসহ বিভিন্ন কৃষি, মৎস্য, প্রাণী—উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে কর রেয়াতিসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মহামারি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত খামারি ও উদ্যোক্তারা যাতে ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সে জন্য খামারিকে নগদ প্রণোদনা এবং সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করতে হবে, যাতে কৃষি উৎপাদনসংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে খাদ্যের বিনিময়ে তাদের সামান্য সম্পদ বিক্রি করতে না হয়। জলবায়ুঝুঁকি মোকাবিলায় ক্ষুদ্র চাষিদের জলবায়ুঝুঁকি বিমা এবং পূর্বাভাসভিত্তিক অর্থায়ন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে: উদাহরণস্বরূপ মহামারির মতো ঘটনার ধাক্কা বা খাদ্যমূল্যের ওঠানামার প্রভাব কমাতে অর্থ বা এ ধরনের সহায়তামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে; পুষ্টিকর খাবারের দাম কমিয়ে আনার জন্য সরবরাহব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে; উদাহরণস্বরূপ জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করে বা ফল ও সবজি উৎপাদকদের তাঁদের পণ্য বাজারে বিক্রি সহজ করার মাধ্যমে; দারিদ্র্য ও কাঠামোগত বৈষম্য সামাল দিতে; উদাহরণস্বরূপ প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং প্রত্যয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র কমিউনিটিগুলোতে ফুড ভ্যালু চেইন জোরদার করার মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছে দিতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থার প্রচলন অতীব জরুরি এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি সুন্দর বিপণনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে সরাসরি কৃষক থেকে সরাসরি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যথায় মহামারির ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত সমস্যাগুলো আরও তীব্রভাবে ফিরে এসে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।

এ কে এম এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]