করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আশার গল্প, শিক্ষারও গল্প

রাজধানীসহ সারা দেশে চলছে কঠোর বিধিনিষেধ। গতকাল িনউমার্কেট এলাকায়ছবি: সাইফুল ইসলাম

বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এ এ পর্যন্ত মারা গেছেন সরকারি হিসাবে প্রায় ২০ হাজার—২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১–এর জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু এখন রোজ মারা যাচ্ছেন ২০০-এর বেশি। চার দিনেই প্রায় এক হাজার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে গত ১৬ মাসে যতজন মারা গেছেন, আগামী ৮০ দিনে ততজন মারা যাওয়ার শঙ্কা আছে। অর্থাৎ করোনা অতিমারির সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিটা আমরা এখন অতিক্রম করছি। কয়েক দিন ধরে রোজ সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে একই রকম: আজ করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

তাহলে কি আমাদের আর কোনো আশা নেই? আমরা হাজার হাজার মানুষকে মরতে দেখব, হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে স্বজনদের ছুটতে দেখব, অক্সিজেনের অভাবে মানুষ কাতরাচ্ছে, সেই ছবি দেখব এবং পরিস্থিতি রোজ আরও একটু খারাপের দিকেই যাবে? আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৬ মাস ধরে বন্ধ রেখেছি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা–সমাবেশ থেকে বিরত থাকছি। মাঝেমধ্যেই কঠোর বিধিনিষেধ আসছে, দোকানপাট, অফিস-আদালত, বাস-ট্রেন-লঞ্চ—সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থা কি চলতেই থাকবে?

আমাদের হয়েছে উভয়সংকট। আমরা অনন্তকাল দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে পারব না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতে দিতেই হবে। অন্যদিকে বিশেষ করে ডেলটা ভেরিয়েন্ট আসার পর করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেশে এত দ্রুত খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে পড়ছে যে হাসপাতালগুলোয় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, সংক্রমণ ও মৃত্যু রোজ রেকর্ড ভঙ্গ করছে এবং ভবিষ্যৎ ভয়াবহ হবে—এমন শঙ্কায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ক্রমাগতভাবে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় নতুন সংক্রমণ রোধ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে ঈদের আগে দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধের পর ঈদের পর আবার দুই সপ্তাহের দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে সরকার বাধ্য হয়েছে।

এ ঘোরতর অমানিশার মধ্যে দুটো উদাহরণ থেকে কিছুটা আশার আলো পাই। একটা হলো ভারতের করোনা পরিস্থিতির গ্রাফ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত ভারতের করোনা পরিস্থিতির লেখচিত্রে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে সেখানকার পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। ভারতে মধ্য মে ২০২১-এ এক সপ্তাহে কোভিডে মারা গেছেন ২৮ হাজার ৯৮২ জন। আস্তে আস্তে সেই মৃত্যু কমছে। জুলাই ২০২১-এর শেষ সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৪২৭ জনের। অর্থাৎ মে মাস থেকে জুলাইয়ে মৃত্যু কমে এসেছে প্রায় ২০ ভাগের ১ ভাগে।

দ্বিতীয় উদাহরণের জন্য আমরা বেছে নেব বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে। মে মাসে এই জেলাকে বলা হতো করোনাভাইরাসের নতুন কেন্দ্র। কিন্তু জুলাই মাসে এসে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর কারণ কী? প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন দিলু বলেন, মে মাসের শেষের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়। ১৪ দিনের সেই বিধিনিষেধ মোটামুটি কঠোরভাবে মান্য করার পর করোনা সংক্রমণের হার কমে আসে। এখন আর রোজ মৃত্যুর খবর লিখতে হয় না। ঈদুল ফিতরের সময় করোনা সংক্রমণের হার ছিল ৬২ ভাগ, জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহে এই হার ১২ ভাগ।

ভারতে করোনার মহামারি থিতিয়ে আসছে কেন? এমন নয় যে তারা অনেক মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে। এ পর্যন্ত পুরোপুরি টিকাপ্রাপ্ত মানুষের হার ভারতে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। তাহলে? একটা উত্তর হলো, তারা উপদ্রুত এলাকাগুলোয় কঠোর বিধিনিষেধ করতে পেরেছে। দ্বিতীয়টা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

বাংলাদেশের বেলাতেও নাগরিকদের প্রথম করণীয় হলো সরকারঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধগুলোকে শতভাগ মান্য করা। অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া। মানুষের নিকট-সংস্পর্শ বর্জন করা। মাস্ক পরা। হাত ধোয়া। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। আমরা ঈদের আগে যে ১৪ দিনের বিধিনিষেধ পর্ব অতিক্রম করলাম, তা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উপকার দেবে। চলমান বিধিনিষেধও সংক্রমণের অতি উচ্চ হার সামলাতে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। যদিও আমরা বিধিনিষেধ পুরোপুরি মানি না, আর ঈদের প্রাক্কালে বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে আমরা গাদাগাদি–ঠাসাঠাসি করেই চলাচল করেছি। তার কুফলও আমাদের করোনাচিত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।

তা সত্ত্বেও বলব, বিধিনিষেধ মান্য করা হলে, স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলা হলে বাংলাদেশেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হতে বাধ্য। ভারতের গ্রাফের দিকে তাকিয়ে আশা করা যায়, আগস্টের শেষের দিকে কিংবা সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে আমাদের কোভিড-গ্রাফের রেখাটি নিচের দিকে নামতে শুরু করবে।

কিন্তু এটা কেবল আশাই। করোনা সম্পর্কে শেষ কথা হলো করোনা সম্পর্কে শেষ কথা কেউ জানে না।

তবে পশ্চিমা দেশের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, টিকা দেওয়াই হলো সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। তাঁরা এ–ও বলছেন, টিকা দিতে হবে একযোগে, সারা পৃথিবীতে, সব মানুষকে এবং দ্রুত। ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের প্রায় সব মানুষকে টিকা দিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর অন্যত্র তা না ঘটে, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র করোনার বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো: না। কারণ, পৃথিবীর অন্যত্র করোনাভাইরাস নিজেকে বদলে ফেলবে এবং তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে। একযোগে পৃথিবীর সবখানে টিকা দেওয়া হলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের জায়গা পাবে না এবং দ্রুতই পৃথিবী থেকে এর বিপজ্জনক রূপটি চলে যাবে। তবে গুটিবসন্তের মতো করোনাভাইরাস পৃথিবী থেকে একেবারে চলে যাবে না। সর্দি–কাশির মতো করে থেকেই যাবে এবং পৃথিবীর মানুষ কোভিডের সঙ্গে বসবাস করার কায়দা রপ্ত করে ফেলবে।

করোনা তো কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটা সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা। করোনার কারণে বাল্যবিবাহ বেড়েছে, স্কুল থেকে শিশুরা চিরকালের জন্য ঝরে পড়ছে, মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে। মাথাপিছু আয় কিংবা জিডিপির অঙ্ক দেখে এই পরিস্থিতির বাস্তবতা বোঝা যাবে না।

তিন সপ্তাহ ধরে এই কলামে একটা কথাই বলার চেষ্টা করছি, আর তা হলো আমরা বিধিনিষেধ করে অনন্তকাল ঘরে বসে থাকতে পারব না। আমাদের বিধিনিষেধ তুলে নিতেই হবে, আবার করোনার হাত থেকেও মানুষকে বাঁচাতে হবে। একমাত্র সমাধান হলো সর্বজনীন টিকাদান। আশার কথা হলো আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার মহাকর্মযজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা, বিশালতা, জরুরিত্ব উপলব্ধি করেছেন। টিকা সংগ্রহ, উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিচ্ছেন। সর্বজনীন টিকা দেওয়ার কাজটা করতে হবে দ্রুত, একযোগে। তা না হলে নতুন ভেরিয়েন্ট এসে যাবে। সুফলটা ভোগ করা যাবে না। প্রতি মাসে ২ কোটি টিকা দেওয়া হলেও ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে ১২ মাস লেগে যাবে। এই সময়টা কমিয়ে ৬ মাসে আনা গেলে আমরা নিজেদের করোনা চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করতে পারব।

করোনা তো কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটা সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা। করোনার কারণে বাল্যবিবাহ বেড়েছে, স্কুল থেকে শিশুরা চিরকালের জন্য ঝরে পড়ছে, মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে। মাথাপিছু আয় কিংবা জিডিপির অঙ্ক দেখে এই পরিস্থিতির বাস্তবতা বোঝা যাবে না। আপনার একজন গাড়িচালক ছিল, স্কুলে বাচ্চা আনা-নেওয়া করত। আপনি তাকে বিদায় করে দিয়েছেন। তঁার সংসার কীভাবে চলছে?

ঢাকার বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট সাইন। পর্যটন স্পটগুলোতে তালা ঝুলছে। স্কুলের সামনে আচার বিক্রি করতেন যিনি কিংবা স্কুলের সামনের দোকানে যিনি বই–খাতা, কলম–পেনসিল বিক্রি করতেন, তিনি এখন কোথায়? দেড় বছর আগে কলেজে ভর্তি হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, এমন শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে যায়নি, ক্লাস করেনি, কয়েক মাস পরে পরীক্ষা দিয়ে তারা পাস করে বেরিয়ে যাবে! এটা হয়! পড়াশোনা করা মানে তো কেবল বইপড়া আর পরীক্ষা দেওয়া নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা কিংবা টিএসসির সামনে দিয়ে হাঁটা কিংবা শিক্ষকদের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটানোর মূল্য যে কত, তা তো অঙ্ক কষে বোঝানো যাবে না।

করোনার এই দুঃসময় অতিক্রম করে সুসময়ের দিকেই যেতে হবে আমাদের। যঁাদের হাতে আমাদের নির্ভরতার চাবি, তঁাদেরকে আমাদের বলতেই হবে, কান্ডারি, হুঁশিয়ার!

আর আমার নিজেকে কী বলব? বলব, আমি কি আমার দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করছি? একটা ছোট্ট সূত্রের কথা আমি প্রায়ই বলি নিজেকে, আবারও বলি, রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার লাইন, ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ নিজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব। তাতে কেবল নিজেকে করোনা থেকে রক্ষা করব তা-ই নয়, করোনা সংক্রমণের শিকলটা ভেঙে দিতেও তো অবদান রাখব।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক