করোনা সমস্যার ডানপন্থী সমাধান

গতকাল বৃহস্পতিবার যখন লিখছি, তখন বিবিসি বলছে যে ব্রাজিলে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৬৪৬ জন। মোট মৃত্যু সাড়ে ৮ হাজার ছাড়িয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এই মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সোয়া লাখ।

তবে ব্রাজিলের চরম ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট করোনাকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছেন না। এই কিছুদিন আগেও এক অনুষ্ঠানে ডজন ডজন নাগরিকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছেন। তাঁর ভাষায়, করোনা হলো একটা ছোটখাটো ফ্লু। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশবাসীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক সময়ের মতো বজায় রাখতে বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাঁর ক্ষমতা বা সামর্থ্য কুলালে ব্রাজিলে করোনার কারণে কিছুই বন্ধ থাকত না।

ব্রাজিলের অনেক অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশের গভর্নররা প্রেসিডেন্ট জোয়ে বলসোনারোর কথায় কান দিচ্ছেন না। তাঁরা লোকজনকে ঘরে থাকতে বলছেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, কলকারখানা-দোকানপাট না খোলা ইত্যাদি পরিচিত সব নির্দেশনা জারি করছেন। বলা বাহুল্য, জনগণ প্রচণ্ড বিভ্রান্তিতে। গভর্নরদের কথা শুনে কেউ বাসায়। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের কথায় দোকানপাট খুলে, রেস্টুরেন্টে আড্ডা মেরে, বিচে হইহুল্লোড়ে ব্যস্ত ব্রাজিলের বহু নাগরিক। ফলাফল আগেই বলেছি, দক্ষিণ আমেরিকায় সর্বোচ্চ মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কীর্তিকাহিনির সঙ্গে ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচণ্ড ডানপন্থী প্রেসিডেন্টও করোনাকে শুরুতে বিশেষ পাত্তা দেননি। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর অবস্থান বদল করেছিলেন। তবে এখন আবার সপ্তাহ দুয়েক ধরে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের লোকজনকে লকডাউন উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর ব্যবসা–বাণিজ্য চালাতে আহ্বান জানাচ্ছেন। অন্যদিকে আমেরিকার এই সব অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট গভর্নররা লকডাউন চালিয়ে যাচ্ছেন। লোকজনকে ঘরে রাখা, কোয়ারেন্টিন বা একলা থাকার নির্দেশ মেনে চলা আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত রাখার নির্দেশনা বজায় রাখছেন।

সৌদি আরব রাজতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খোলা তো দূরে থাক, আরোপ করেছে সবচেয়ে কঠোর লকডাউন। মুসলিম বিশ্বে মসজিদের ব্যাপারে প্রথমে তারাই সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ইরানের যেসব এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব হয়নি বা খুবই অল্প, দেশের সেই রকম এক–তৃতীয়াংশ এলাকায় এখন মসজিদ খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের বাকি অংশে মসজিদ এখনো বন্ধ। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এখন দোকানপাট খুলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সবার জন্য মাস্ক আর গ্লাভস অবশ্যপরিধেয়। সৌদি আরবে দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছে ২৯ এপ্রিল, কিন্তু বলা হয়েছে যে এসব খোলা থাকবে ১৩ মে পর্যন্ত।

চীনসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ করোনা সংক্রমণ রুখতে পেরেছে, তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল কঠোর লকডাউন। বেশ কয়েক দিন ধরে টেলিভিশনের খবরে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গিজগিজ করা মানুষের ছবি দেখাচ্ছে। হাটবাজারে, অনেক রাস্তার মিলনস্থলে (যেমন ঢাকার যাত্রাবাড়ী) এবং অন্যান্য স্থানের এসব ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই দেশে লকডাউন চলছে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ইত্যাদির লকডাউন ছিল বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মোদ্দা কথা, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো গুরুত্ব দিচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে। ওই দুই দেশের ডানপন্থী প্রেসিডেন্টের জন্য স্পষ্টতই জীবন থেকে জীবিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়াতে আর খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ট্রাম্পের কাছে অর্থনীতি তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পক্ষান্তরে, অনেক দেশ আগে জীবনকে স্থান দিয়েছে। চীন তাদের আক্রান্ত এলাকাগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে একপর্যায়ে সংক্রমণও বন্ধ হয়ে যায়। তারা এখন অর্থনীতির চাকা আবার খুলে দিয়েছে। আগে জীবন বাঁচিয়েছে, এখন অর্থনীতি বাঁচাবে। তাইওয়ান, হংকংও অর্থনৈতিকভাবে সচল হয়েছে। লকডাউনের কড়াকড়ির সুবাদে ওই সব দেশে জীবনহানি হয়েছে নগণ্য (হংকংয়ে সর্বমোট মৃত্যু ৪ আর তাইওয়ানে ৬)।

আমাদের দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য খোলার দিন–তারিখ ঠিক হয়েছে। মসজিদ খুলে গেছে। পোশাক কারখানা খুলেছে বেশ কয়েক দিন। একবার শ্রমিকদের আসতে বলে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত আনিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। আবার আনা হয়েছে। তাঁরা গাদাগাদি করে কাজ করছেন। দোকানপাট খুলে দেওয়ার ঘোষণার পর অর্থনৈতিক জীবন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। স্বাস্থ্যবিশারদেরা যে কিছু জানেন বা বোঝেন, তা অন্তত নীতিনির্ধারকেরা মানেন বলে মনে হচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় যা পড়ছি বা টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখছি, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে স্বাস্থ্যবিশারদেরা এত সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে সায় দিচ্ছেন না। আর নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, দোকানপাট, বাজার–হাট, মিল-ফ্যাক্টরি সবকিছু খুলে গেলে সংক্রমণ বাড়বে, এ রকম অবাস্তব চিন্তায় স্বাস্থ্যবিশারদেরা মশগুল। অর্থাৎ, নীতিনির্ধারকেরা ভাবছেন স্বাস্থ্যবিশারদদের দুশ্চিন্তা অবাস্তব। অর্থনীতি আগে, জীবন পরে। নীতিনির্ধারকেরা হয়তো ভাবছেন, অর্থনীতি চালু না হলে অনাহারে–অর্ধাহারে বহু লোক মৃত্যুবরণ করতে পারে। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ হলেও এতে মৃত্যুর সংখ্যা থাকবে অনেক কম। তাই দুই মন্দের মধ্যে অর্থনীতি সচল করাটা অপেক্ষাকৃত কম মন্দ।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হলে কীভাবে সংক্রমণ হবে বা বাড়বে, করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার কী ব্যাঘাত হবে, করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে অন্যান্য রোগীর এগারোটা না বারোটা বাজবে ইত্যাদিসহ আনুষঙ্গিক আরও বিষয়ে স্বাস্থ্যবিশারদেরা নিশ্চয় তাঁদের মতামত দিয়েছেন। স্পষ্টতই তাঁদের এসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সরকার ১৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও স্বাস্থ্যবিশারদকে নিয়ে যে কমিটি করেছিল, কয়েক দিন আগে তাঁদের প্রদত্ত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবের চমকপ্রদ মন্তব্য পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। অতিরিক্ত সচিবের কথায়, ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি নতুন আর কী বলেছে। তারা যা বলেছে আমরা সেগুলো জানি’ (স্মৃতি থেকে বলছি, দু–একটা শব্দ এদিক–সেদিক হতে পারে)। মোদ্দা কথা, অর্থনীতি মুখ্য, স্বাস্থ্য গৌণ।

এটা নিঃসন্দেহে ডানপন্থী সমাধান। ট্রাম্প-বলসোনারোর সমাধান। বলা বাহুল্য, এক দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদির বিষয়ের সঙ্গে অন্য দেশের মিল না থাকাই স্বাভাবিক। অনেকেই যুক্তি দেখাতে পারেন যে ব্রাজিলের সরকার বা ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র যা করছে, আমাদের সরকার হুবহু তা–ই করছে না। সঠিক যুক্তি। ওদের পোশাক কারখানা নেই, কিন্তু আমাদের আছে। ব্রাজিলে মসজিদের সংখ্যা, ধারণা করছি গুটিকয়। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক শ হতে পারে। আমাদের কমবেশি ৪ লাখ অর্থাৎ, পরতে পরতে অমিল।

তা সত্ত্বেও বড় দাগে সমাধানের একটা আদর্শিক সামঞ্জস্য স্পষ্ট। একটা সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন পথ থাকতে পারে। বিভিন্ন দেশ বা সমাজ ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নেয়। যারা পথ বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের বহু যুক্তি থাকে। ধরেই নিচ্ছি আমাদের সরকার চিন্তাভাবনা করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া আর দোকানপাট চালু করার সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে। এই পথে ফল আসবে কি না, তার জন্য আরও দিন দশেক হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি সাফল্য আসে, তাহলে ধরে নিতে হবে করোনা মোকাবিলায় ডানপন্থা জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে।

তবে কোনো কারণে স্বাস্থ্যবিশারদদের আশঙ্কা যদি সঠিক প্রমাণিত হয়, তাহলে আমাদের অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেই দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম করে কোনো লাভ হবে না। দেখা যাক, কপালে কী আছে!

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক