করোনাভাইরাসের থাবা থেকে আমরা কি মুক্ত

করোনাভাইরাসের
প্রতীকী ছবি

গত ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, করোনাভাইরাস আমাদের দেশ থেকে বিদায়ের পথে, এটি আপনা থেকেই চলে যাবে। এরপর ২৮ আগস্ট তিনি দাবি করেন, করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফল। এর বিপরীতে বিখ্যাত স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, এমনকি লাগামহীনও হয়ে যেতে পারে। আমাদের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। এ দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানের কোনটি বিশ্বাসযোগ্য?

আইইডিসিআরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯১৬ জন সংক্রমিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৪ হাজার ৯৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও ল্যানসেট প্রতিবেদনে এর চার গুণের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন বলে দাবি করা হয়। তাই করোনাভাইরাসের আক্রমণে সরকার প্রকাশিত মৃতের সংখ্যা বাস্তবতার প্রতিফলন নয় বলে অনেকের ধারণা। শুধু মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েই নয়, সরকারের প্রকাশিত আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়েও অনেকের মনে সন্দেহ রয়েছে। আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির উদ্যোগে ঢাকা মহানগরে পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগরের ৯ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।

গত এপ্রিল মাসেই সরকার ঘোষণা করেছে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো এপ্রিল মাসে সাধারণ ছুটি ঘোষণা এবং দুই ঈদের সময়ে শহর থেকে গ্রামে যাওয়া-আসা এবং ভাইরাসের কারণে অনেক কর্মহীন মানুষের শহর থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তন। প্রবাসে কর্মরত অনেক ব্যক্তির তাঁদের জন্মস্থানে ফিরে আসা এবং তাঁদের কোয়ারেন্টিনে না রাখতে পারার কারণেও করোনাভাইরাস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

যদি ধরে নেওয়া হয় যে ঢাকার মতো সারা দেশেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ৯-১০ শতাংশ, তাহলে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে দেড় কোটির বেশি মানুষ এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। আর আমরা যদি ধরেও নিই যে গ্রামে আক্রান্তের হার কম এবং বাংলাদেশে গড়ে ৫ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তাহলেও অন্তত ৮৫ লাখ মানুষ বর্তমানে এ ভাইরাসের রোগী। তবে সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ঢাকার বাইরে তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা কম হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের আপত্তির মুখেও সরকার পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে বিশেষজ্ঞ প্যানেল অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করলেও এ পর্যন্ত সরকার এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা জানি না সরকার কী যুক্তিতে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে কিংবা কেন অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন টেস্ট করার অনুমতি দিচ্ছে না। এ ছাড়া নমুনা পরীক্ষার এবং এর ফলাফল প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এ পরীক্ষার উদ্দেশ্যকেই ভন্ডুল করে দিচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার উদ্দেশ্যই হলো রোগী শনাক্ত করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের পৃথক থাকার ব্যবস্থা করা, যাতে তাঁরা অন্যদের সংক্রমিত করতে না পারেন। তবে নমুনা পরীক্ষা করতে এবং ফল পেতে যদি কয়েক দিন লেগে যায়, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এ সময়ে অন্যদের সংক্রমিত করতে থাকেন।

যেহেতু জনগণের ভাইরাস সম্পর্কে ভয় কেটে গেছে, তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না এবং সরকারের পক্ষ থেকেও পর্যাপ্ত পরীক্ষা করে রোগীদের পৃথক করা ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। তাই করোনাভাইরাসের দুষ্ট থাবা থেকে আমরা কোনোভাবেই মুক্ত নই। বরং ভবিষ্যতে আমাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে

আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি পরিচালিত জরিপ থেকে আরও জানা যায়, আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭৮ শতাংশের মধ্যে কোনো লক্ষণ নেই। তাই বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটির মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থাকলে লক্ষণবিহীন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৮ লাখের মতো, যাঁরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়াচ্ছেন, কারণ লক্ষণহীন বলে কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাঁদের পৃথক করে রাখার উদ্যোগ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, তাঁরা নিজেরাও পৃথক থাকছেন না।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের ঝুঁকি থেকে মুক্ত কি না, তা নির্ভর করে টেস্ট পজিটিভিটি রেট বা নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হারের ওপর। প্রথম দিকে রোগী শনাক্তের হার কম হলেও মে মাসের শেষ সপ্তাহে এ হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০ আগস্ট পর্যন্ত কয়েক দিন ছাড়া দৈনিক রোগী শনাক্তের হার ছিল ২০-২৫ শতাংশ। এরপর এ হার ২০ শতাংশের নিচে নামতে থাকে, যা ১৭ সেপ্টেম্বর ১১ দশমিক ৯১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে রোগী শনাক্তের হার বেশি, এমন শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন একটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, টানা তিন সপ্তাহ যদি টেস্ট পজিটিভিটি রেট বা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে শর্ত হলো প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে এবং দেশের সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে (প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

রোগী শনাক্তের হার কম হলেও বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো কমেনি। কোনো দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে তার আরেকটি নির্দেশক হলো টানা তিন সপ্তাহ মৃত্যুর সংখ্যা কমতে থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে টানা মৃত্যুর সংখ্যা কমতে দেখা যায় না (প্রথম আলো, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০)। তাই আমাদের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার দাবি অমূলক বলেই অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা।

পরিশেষে, যেহেতু জনগণের ভাইরাস সম্পর্কে ভয় কেটে গেছে, তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না এবং সরকারের পক্ষ থেকেও পর্যাপ্ত পরীক্ষা করে রোগীদের পৃথক করা ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না, তাই করোনাভাইরাসের দুষ্ট থাবা থেকে আমরা কোনোভাবেই মুক্ত নই। বরং ভবিষ্যতে আমাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আর করোনাভাইরাসের মিউটেশনের মাধ্যমে ‘কেস ফেটালিটি রেট’ বা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর হার যদি বেড়ে যায়, যা এখন নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, তাহলে ভাইরাসটি বিধ্বংসী আকার ধারণ করে বিরাটসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। এ ধরনের পরিণতি এড়াতে হলে আমাদের এখনই সাবধান এবং জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক