করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি অর্থনীতির জন্য কতটা ক্ষতিকর

করোনাভাইরাসের টিকা ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা এ টিকার প্রথম ডোজ পেয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া টিকাগুলোর কার্যকারিতা ৯০-৯৫ শতাংশ। যার অর্থ হলো টিকা পেয়েছে এমন প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ জনের কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা একেবারেই কম। বাকি ৫ থেকে ১০ জন কোন কারণে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হলেও তাঁদের মধ্যে রোগের ভয়াবহতা মারাত্মক না–ও হতে পারে। বাংলাদেশও শিগগিরই কোভ্যাক্সের মাধ্যমে টিকা পেতে যাচ্ছে, যা প্রথম পর্যায়ে দেশের সব স্বাস্থ্যকর্মী এবং জনস্বার্থে নিয়োজিত করে এমন সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্রয়োগ করা হবে।

কোভ্যাক্স (COVAX) হলো একটি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো জরুরি ভিত্তিতে কোভিড-১৯ টিকা সংগ্রহ করতে পারবে এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি দেশের জনসংখ্যার প্রথম ২০ শতাংশের কাছে গুরুত্বের ভিত্তিতে পৌঁছে দিতে পারবে। এই ২০ শতাংশের মধ্যে থাকছে স্বাস্থ্যকর্মী, দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী এবং প্রৌড় নাগরিক। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জনগোষ্ঠীর কাছে করোনাভাইরাসের টিকা পৌঁছে দেওয়াই সরকার এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাদের উদ্দেশ্য।

দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টিকা প্রয়োগের পাশাপাশি সবাইকে মুখে পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমেই সম্ভব দেশকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা। এবং এই কাজ যতটা দ্রুত সময়ের মধ্যে করা যায়, ততটাই মঙ্গল। তা না হলে কোভিড-১৯ সহ অন্যান্য রোগে ভুগে মৃত্যুর মিছিল বাড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দা যে আমাদের কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।

কিন্তু যে মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যান্য দেশসহ আমরা কোভিড-১৯-এর নিষ্ঠুর থাবা থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখছি, সেই মুহূর্তেই যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, যা আমাদের সবাইকে একটি নতুন শঙ্কা এবং অজানা ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ভয়ের প্রধান কারণ হলো এই পরিবর্তিত করোনাভাইরাসটি মূল ভাইরাসটির চেয়ে নিদেনপক্ষে ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক এবং এর বিস্তারের ফলে পৃথিবী একটি নতুন সংকটের মধ্যে আবর্তিত হবে। ইতিহাসের দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কার হওয়ায় আমরা যে আশার আলো দেখছিলাম, সেই আলোটি নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রথম এই পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করে। এই দিনই লন্ডন শহরকে তৃতীয়বারের মতো লকডাউন করে দেওয়া হয় এবং নতুনভাবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা হয়। যুক্তরাজ্যের পরপরই জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং ও অস্ট্রেলিয়াও নতুন ধরনের এই পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত করে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানায়।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে কয়টি বিষয় পাঠকদের জন্য জানা জরুরি তা হলো (১) করোনাভাইরাসের পরিবর্তন বা মিউটেশন কীভাবে হয়; (২) পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ টিকা কার্যকর কি না; (৩) যুক্তরাজ্যের বাইরে পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা কতটুকু; (৪) এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থার ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলবে; এবং (৫) পরিবর্তিত করোনাভাইরাস অর্থনীতির ওপর কোন ধরনের বাড়তি প্রভাব ফেলবে। আমি খুব সংক্ষেপে ওপরের পাঁচটি বিষয়ের আলোকপাত করব।

১. করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন: আসলে ভাইরাস প্রাণিদেহে জায়গা করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তিত হতে থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়। এখন পর্যন্ত জানা বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে, প্রতি দুই সপ্তাহে মানব শরীরে করোনাভাইরাস পরিবর্তিত হয় (এর মিউটেশন ঘটে)।

তবে পরিবর্তিত করোনাভাইরাস মূল ভাইরাসটির চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি হারে সংক্রমিত হলেও কোভিড-১৯ রোগের ভয়াবহতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কিন্তু বেশি নয়। পরিবর্তিত করোনাভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিকে অধিক হারে সংক্রমিত করলেও ভয়াবহতার দিক থেকে অধিক পরিমাণে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তথাপি নতুন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশেষজ্ঞরা সবাইকে ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর অধিক হারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

২. সদ্য আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ টিকা কার্যকর কি না: এই বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এখন পর্যন্ত তাদের হাতে বিস্তারিত তথ্য নেই, যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে পরিবর্তিত ভাইরাসটির সঙ্গে টিকার কার্যকারিতার কোনো সম্পর্ক আছে কি না।

বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং এই তথ্য জানার জন্য আমাদের আরও ২-৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে। আশার কথা হলো, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা ইতিমধ্যে তাঁদের জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন যে এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি, যার ভিত্তিতে বলা যাবে যে বর্তমানে আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ টিকা পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।

পরিবর্তিত করোনাভাইরাস যেন আমাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও অতিসত্বর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বিষেধাজ্ঞা জারি করা প্রয়োজন। নিষেধাজ্ঞা জারিতে সমস্যা থাকলে অবশ্যই বিদেশফেরত সব যাত্রীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. যুক্তরাজ্যের বাইরে পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ভয়বহতা: যুক্তরাজ্যে যে ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটা ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র, যেমন ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সেও শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং অস্ট্রেলিয়াতেও নতুন ধরনটির সন্ধান পাওয়া গেছে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে পরিবর্তিত নতুন ভাইরাসটির ব্যাপারে সাধারণ জনগণের মধ্যে রেড এলার্ট জারি করেছেন এবং সবাইকে মাস্ক পরাসহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশগুলোতেও অনুরূপ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলোর ওপর আবারও অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এটাই প্রচার করছে যে দেশের জনগণ, স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি বাঁচাতে হলে ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। শুধু টিকার ওপর নির্ভর করে এই মহামারির হাত থেকে বেঁচে আসা সম্ভব নয়।

৪. আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থার ওপর প্রভাব: সব দেশ আবারও আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে জাপান এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশ যেমন সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্ডিয়া এবং হংকংয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে আসা সব যাত্রীদের দেশের ভেতরে প্রবেশে সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাজ্য থেকে আসা সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে চীনও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সব ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

৫. অর্থনীতির ওপর প্রভাব: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং নতুন করে আরোপ হওয়া সংশয় বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আবারও মেঘাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। সবার মধ্যে কাজ করছে বাড়তি শঙ্কা। বিশ্বের সেরা মোটরযান প্রস্তুতকারক টয়োটা ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে এবং ফ্রান্সে তাদের প্ল্যান্ট বন্ধ করে দিয়েছে।

লাইফ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিডিও কুমানো বলেছেন অর্থনীতির ওপর পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের প্রভাব নির্ভর করবে বর্তমানে আবিষ্কৃত টিকার কার্যকারিতার ওপর। কার্যকারিতা আশানুরূপ না হলে বিশ্ব অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার যত পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলো আবার নতুন করে ভাবতে হবে। এ ছাড়া কোভিড-১৯ টিকা তৈরি ও সরবরাহের পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রথম থেকেই বাংলাদেশে নানা দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে। শনাক্তকরণ পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে জনসাধারণকে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটেছে, বাড়তি খরচের অভিশাপ বইতে হয়েছে অনেক পরিবারকে, সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হয়েছে অনেক পরিবার।

তাই সরকারসহ সব স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। দক্ষভাবে সততার সঙ্গে ভুলগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে, যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে। বিশেষ করে লক্ষ রাখতে হবে, কোভিড-১৯ টিকা যেন অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের সব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। টিকা নিয়ে আমরা যেন আরও একবার অসাধুতা ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত না হই , সেদিকে সরকারকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।

পরিবর্তিত করোনাভাইরাস যেন আমাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও অতিসত্বর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বিষেধাজ্ঞা জারি করা প্রয়োজন। নিষেধাজ্ঞা জারিতে সমস্যা থাকলে অবশ্যই বিদেশফেরত সব যাত্রীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাইকে মুখে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে হবে এবং যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে অদূর ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ থেকে আমাদের পরিত্রাণ মিলবে না। অর্থনৈতিক ভয়াবহতার কথা না–ই বা বললাম।

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ