করোনাযুদ্ধে সব ফ্রন্টে দক্ষ সেনাপতি দরকার

এক বছর ধরে করোনা মোকাবিলায় বেশ সাফল্য অর্জন করার পর দ্বিতীয় ঢেউ সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। যুদ্ধজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে শত্রুপক্ষ তীব্র পাল্টা আক্রমণ করলে যে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, অবস্থাদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। করোনাযুদ্ধের সেনাপতিরা তাই হয়তো খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আগের মতো বিচক্ষণতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারছেন না।

করোনাযুদ্ধে অনেক ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছে। একদিকে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে সংক্রমণ শনাক্ত করে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। জনসমর্থন আদায় ও গুজব প্রতিরোধ আরও একটা ফ্রন্ট। প্রতিটি ফ্রন্টের অবস্থা গত বছরের তুলনায় একটু বেশি নড়বড়ে মনে হচ্ছে। যেমন গতবার লকডাউন বা সাধারণ ছুটিকালে এত এলোমেলো অবস্থা দেখা যায়নি। সহযোদ্ধা প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে আমরা যখন হাসপাতালে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণ করতে যেতাম বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এসব সরঞ্জামের অনুমোদনের জন্য যেতাম, তখন রাস্তাঘাটে যথেষ্ট সুনসান নীরবতা লক্ষ করেছি। কিন্তু এবারের লকডাউনে জনসমাগম তেমন কমেনি। লকডাউনের তৃতীয় দিন থেকে তো শহরে গণপরিবহন চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি এ বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনার অভাব ছিল? লকডাউন বা গণপরিবহন বন্ধের প্রতি যে জনগণের সমর্থন নেই, তা–ও কি একটু ভাবা দরকার ছিল না?

দ্বিতীয় ফ্রন্টে, অর্থাৎ সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি ও শক্তি ক্রমে সংহত হয়েছে। আমরা এখন প্রতিদিন ৩০ হাজারের বেশি পরীক্ষা করার সক্ষমতা অর্জন করেছি। চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে গত বছরের মতো হাহাকার নেই। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্রতা এত বেশি যে এ ক্ষেত্রেও সংকট কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেসব পরিবারে করোনা রোগী বা অন্য রোগী আছেন, যাঁদের এ মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন, তাঁরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করছেন। আর আমরা যতই অর্থবান বা ক্ষমতাশালী হই না কেন, আইসিইউ জোগাড় করা তো সোনার হরিণ ধরার চেয়েও কঠিন। তাই এ মুহূর্তে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে ব্যাপক জন-অসন্তোষ তৈরি হতে পারে।

গুজব ছড়ানো বা গণমাধ্যমকে ভিন্ন পথে ব্যবহার করা যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একটা পুরোনো কৌশল। কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করে গুজব ছড়াতে পারে। গুজব ছড়িয়ে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার থানা ও উপজেলা পরিষদে হামলা থেকে নিশ্চয়ই বিষয়টি স্পষ্ট যে করোনাযুদ্ধে গুজবকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অবস্থা অব্যাহত থাকলে স্থানীয় প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে করোনা মোকাবিলা করতে চাইবে না। জনসমর্থন করোনাযুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার। গত এক বছরেও আমরা মাস্ক পরিধানসহ করোনা মোকাবিলার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহারে জনগণের ব্যাপক সাড়া পাইনি।

প্রতিটি ফ্রন্টে দুর্বলতার চিহ্ন তাই স্পষ্ট। মোটকথা, নতুনরূপে রণসাজে সজ্জিত তীব্র আক্রমণকারী করোনার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে তো পুরোনো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হবে না। পুরোনো কৌশল দিয়ে তো নয়ই। তার জন্য চাই কার্যকরী নতুন কৌশল। এই নতুন কৌশলের জন্য প্রতিটি ফ্রন্টে দরকার একেকজন সাহসী ও বিজ্ঞ সেনাপতি। আর সবার ওপর দরকার একজন বিচক্ষণ প্রধান সেনাপতি।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোনো কোনো ফ্রন্টে হয়তো একাধিক সেনাপতি আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ এবং চেইন অব কমান্ডের তীব্র অভাব পরিলক্ষিত। আর এই দুটিই তো যুদ্ধজয়ের প্রধান নিয়ামক। যুদ্ধরত বাহিনী যতই শক্তিশালী হোক না কেন, শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড না থাকলে শত্রুপক্ষের ঘায়েলের শিকার হওয়া সহজ। চেইন অব কমান্ডের অভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ যেসব দপ্তর করোনা মোকাবিলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, সেখানকার অনেক কর্মকর্তারই এখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা কঠিন। দীর্ঘকালব্যাপী যোগ্যতা, দক্ষতা এবং দেশপ্রেমের পরিবর্তে সংকীর্ণ দলীয় বিবেচনায় এবং সিন্ডিকেট চক্রের প্ররোচনায় প্রমোশন এবং পদায়ন করাই এ অবস্থার মূল কারণ। অবস্থাদৃষ্টে এমনও মনে হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের পাণ্ডিত্য ও অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটাই তো স্বাভাবিক। গুগল-পণ্ডিতদের এই যুগে তো বিশেষজ্ঞ বাছাই করা কম কষ্টের কাজ নয়। তবে একজন সত্যিকারের দক্ষ ব্যবস্থাপক বা সেনাপতির প্রকৃত বিশেষজ্ঞ বাছাই করার যোগ্যতা থাকাও দরকার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ছোটবেলায় পঠিত ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ এবং ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’—এই দুটি প্রবাদবাক্যের সার্থক প্রয়োগ হচ্ছে।

তাই আমাদের উদাত্ত আহ্বান, প্রতিটি ফ্রন্টে একজন সাহসী, দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হোক। আর এ ক্ষেত্রে সততা, যোগ্যতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমের ওপর জোর দিন। এই সেনাপতিদের প্রথম দায়িত্ব হলো প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের উপযুক্ত পদে পদায়ন করা এবং চেইন অব কমান্ড পুনঃস্থাপন করা। আর প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী করোনাযুদ্ধের কৌশল ঢেলে সাজানো। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও জননেত্রী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি বরাবরের মতো সুদক্ষ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে এবারও জাতিকে ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে মুক্ত করবেন—এটাই দেশের সব মানুষের প্রত্যাশা। আর জাতির এই দুর্দশালগ্নে বঙ্গবন্ধুর মতো উদাত্ত কণ্ঠে করোনাযুদ্ধে সবাইকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাতে বিনীত অনুরোধ করছি।

অন্যদিকে, দেশের এই চরম সংকটকালে সব রাজনৈতিক দলের উচিত বিভেদ ভুলে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরিক হওয়া এবং জনগণকে মাস্ক পরিধান, টিকা গ্রহণসহ করোনা প্রতিরোধের স্বীকৃত পদ্ধতির অনুসরণের জন্য আহ্বান করা। রাজনীতি, সমাজনীতি—সবই তো মানুষের কল্যাণে। একাত্তরের পরে জাতির জীবনে এমন দুর্যোগের ঘটনা তো বেশি নেই। আমরা যদি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবাই এক হতে পারি, তাহলে এখন কেন নয়! তাই আসুন পুরোনো বিভেদ ভুলে জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই সংহতি প্রকাশ করি এবং করোনার তীব্র আক্রমণের বিরুদ্ধে আমরাও প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ করে দেশকে করোনার অভিশাপ থেকে মুক্ত করি। আসুন ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী, গণমাধ্যমকর্মীসহ সবাই মিলে এক বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে করোনা প্রতিরোধে এবং সংক্রমিত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করি।

ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়