করোনার এই সংকটে নারীর সংকট বেশি

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানোর প্রধানতম উপায় ঘরে থাকা অর্থাৎ বাইরের পরিবেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা। পৃথিবীজুড়ে অনুরোধে, আদেশে, শাসনে, ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবু মানুষের সব প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জ্যামিতিক হারের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে এই সর্বনাশা ভাইরাসের সংক্রমণ। শুধু স্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্যসেবার ওপরেই নয়, বরং মানবজীবনের প্রতিটি দিকেই এই সময়টার প্রভাব খুব তাৎপর্য নিয়ে পড়তে শুরু করেছে।

দুর্যোগ যখন আসে, তা নারী-পুরুষ কাউকে ছাড়ে না। তবে সমাজ ও সমাজের জেন্ডার সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে দুর্যোগের অভিজ্ঞতা নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা রকম হয়ে যায়। যদিও এখনো তেমন করে কোভিড-১৯ সংক্রমণের জেন্ডারভিত্তিক উপাত্ত প্রকাশিত হয়নি, তবে অতিসম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার নারী ও পুরুষের সমান, তবে মৃত্যু ঝুঁকি এবং মৃত্যুহার দুটোই নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি। এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে নারী-পুরুষের রোগ প্রতিরোধ করার বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য।

এই সংকটের সময়ে সমাজে বিদ্যমান জেন্ডার সম্পর্ক নিতে পারে নতুন মোড়। ঘরে থাকার সুযোগ পরিবারের পুরুষ সদস্যকে এনে দিচ্ছে ঘরের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ। বাইরে যাওয়া কম, স্কুল বন্ধ, গৃহকর্মীরাও আসছেন না। কাজের চাপ খুব বাড়তি। সারা দিন ঘরের শিশু ও বৃদ্ধদের সব রকমের দেখভালসহ নানা কাজকর্ম, যা নারী গৃহের কাজের চাপকে আরও ভারী করবে এবং করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘাঁটলে দেখা যায়, অনেক পুরুষ ঘরের বিভিন্ন কাজে নিজের অংশগ্রহণের চিত্র এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন। এই সুযোগ হতে পারে তাঁদের জন্য অনন্য।

আমরা জানি, নারী কর্মক্ষেত্রে, অর্থ উপার্জনে যতটা এগিয়ে এসেছেন, পুরুষ আসেননি ততটা ঘরের কাজে। ঘরে থাকার এই সময়ে আমাদের যে তথাকথিত জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিন্যাস রয়েছে, তা ভেঙে ফেলতে পারি আমরা। গবেষণা বলে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যায় জেন্ডারভিত্তিক কাজের বিন্যাস। যেমন প্রবাসী বাঙালি নারী-পুরুষ উভয়ই একসঙ্গে ঘরগৃহস্থালির কাজ ভাগ করে নেন, যা আমাদের সমাজে এখনো তেমন দেখা যায় না। হোম কোয়ারেন্টিনের এই দিনগুলোই হোক পারিবারিক সেবামূলক কাজে পুরুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিন্যাস ভাঙার এক অনন্য উপায়।

এটি যেমন আশার কথা, পুরো চিত্রটা কিন্তু এমন আশাজাগানিয়া নয়। বরং শঙ্কারই বেশি। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করেছে, হোম কোয়ারেন্টিন কী করে বাড়াচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতার হার। চীন, ব্রাজিল, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ আক্রান্ত অনেক দেশেই ইতিমধ্যেই বেড়েছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা।

বাংলাদেশে আমরা জানি, প্রতি দুজনে একজন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। অন্যভাবে বললে, প্রতি দুজনে একজন নারী যে পরিবারে থাকেন, সেখানে এক বা একাধিক সহিংস কেউ রয়েছে। যেহেতু এখন বাইরে বেরোচ্ছে না তেমন কেউ, অর্থাৎ এই সহিংস মানুষের সঙ্গে থাকার সময় আরও লম্বা হয়েছে, সঙ্গে অনেক পরিবারে যুক্ত হয়েছে উপার্জন হারানোর শঙ্কা, সম্ভাব্য খাদ্য অনিরাপত্তার আশঙ্কা, হঠাৎ নেমে আসা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, খুবই সীমিত চলাচল এবং প্রতিনিয়ত কোভিড–১৯ ছড়িয়ে পড়ার খবরে ক্রমবর্ধমান ভীতি। এসব কিছু সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে আরও বেশি।

সাধারণত দুর্যোগের সময়ে নারীরাই থাকেন সামনের লাইনে যেমন দুর্যোগ মোকাবিলায়, তেমনি পরিবার দেখাশোনায়। তথ্য–উপাত্ত বলছে গোটা পৃথিবীতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীবাহিনী মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী এবং এই নারীদের অনেকেই একই সঙ্গে পরিবার দেখভালের মূল দায়িত্বও পালন করছেন। যেহেতু তাঁরাই ঘরে এবং কর্মক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারীর দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

২০১৪-১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা সংক্রমণের সময় ও দেখা গেছে, নারীরা আক্রান্ত হওয়ার উচ্চতর ঝুঁকিতে ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, গৃহ সহিংসতা, যৌন সহিংসতা এবং কিশোরীদের গর্ভধারণের হারও বেড়ে যায় সে সময়। দুর্যোগে নারীর সব ধরনের ঝুঁকি বাড়ে, অর্থনৈতিক, শারীরিক, মানসিক, সহিংসতার ঝুঁকি। এই করোনা দুর্যোগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এটি মোকাবিলায় আমাদের সীমিত যোগাযোগ ও চলাচলের কারণে সহিংসতা–সম্পর্কিত স্বাস্থ্যসেবা ও আইনি সেবা সীমিত হয়ে পড়তে পারে। এবং তেমনটি হলে নারীর ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়বে।

যখন আমরা ঘরে রয়েছি, তখন আমাদের সহযোগিতার কাজে রয়েছে প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক এবং আরও বেশ কিছু শ্রেণি–পেশার মানুষ। যদিও এখন প্রধানতম লক্ষ্য করোনার সংক্রমণ ঠেকানো। তবু নজর রাখা প্রয়োজন কোনো পরিবার যেন খাদ্যসংকটে না পড়ে যায়। সেই সঙ্গে করোনা সংকটের নেতিবাচক ফল হিসেবে পারিবারিক সহিংসতা যেন না বাড়তে পারে, সে জন্য সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরলস কাজ করেই যাচ্ছেন এই দুঃসময়ে মানুষের সেবায়। সহিংসতার শিকার পরিবারের সদস্য যাতে জরুরি সেবা পেতে পারে, তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

তবে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানভেদে নারী-পুরুষের করোনা মহামারি মোকাবিলার অভিজ্ঞতাতেও থাকবে বিস্তর পার্থক্য। যাঁরা দৈনিক উপার্জনে চলেন, তাঁদের অনেকেই অনাহারে দিন যাপন করছেন। তাঁদের ত্রাণ ও অন্যান্য সাহায্য সরবরাহের জন্য সরকার এবং সাধারণ মানুষের আন্তরিক উদ্যোগ মানবিক বাংলাদেশের চিত্র সামনে আনে। বাংলাদেশে ১৪ শতাংশের বেশি পরিবার রয়েছে, যা শুধু নারী দ্বারা পরিচালিত, যাকে বলা হয় ফিমেল হেডেড হাউসহোল্ড।

সীমিত যোগাযোগের এই সময়ে পরিবারে শিশু বা বয়স্ক সদস্যদের রেখে কাজে বা সাহায্যসামগ্রী জোগাড়ে যাওয়ার উপায়ও সীমিত তাঁদের জন্য। রয়েছে তেমন অনেক প্রান্তিক পেশার নারী-পুরুষ, যাঁদের এই জটিলতম সময়ের সবকিছু বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাঁদের চিহ্নিত করে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।

অন্যান্য দুর্যোগের মতো এই সময়েও নারীরা যেহেতু কাঁধে নিয়েছেন ঘরে-বাইরে সেবার ভার, নারীর দুর্যোগ অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় এনে, বিরাজমান জেন্ডার ভূমিকাকে মাথায় রেখে, নারী-পুরুষের ঝুঁকির দিকগুলো আলাদা করে চিন্তা করে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। কোভিড–১৯ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও হতে হবে জেন্ডার সচেতন। স্বাস্থ্যসেবায় শ্রেণি ও জেন্ডার–ভেদে যে অসমতা রয়েছে, তা কমিয়ে আনতে হবে।

(এই লেখাটিতে আমাকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী তাসনিম নওশিন ফারিহা। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ)

সানজীদা আখতার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন।