করোনার কারণে প্রাণহীন পয়লা বৈশাখ

পুরোনো আলপনাতেই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রঙের প্রলেপ দিচ্ছেন দেখন বালা। গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকইল গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
পুরোনো আলপনাতেই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রঙের প্রলেপ দিচ্ছেন দেখন বালা। গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকইল গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

গত পাঁচ শ বছরের মধ্যে এবারই বেদনাভারাক্রান্ত এক পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ বাঙালির মিলনের দিন। দিনটি এবার নিস্তব্ধতায় প্রাণহীন। এক অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ এসেছে ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষার। মিলনমেলা আর সামাজিক দূরত্ব একেবারেই দুই ভিন্ন ব্যাপার। মিলনমেলার আনন্দের চেয়ে জীবন বাঁচাতে বিষাদময় স্বেচ্ছাবন্দিত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যে দিনটিতে শত শত বছর ধরে জেগে ওঠে কৃষিপ্রধান বাংলার গ্রামীণ জীবন, সেই দিনের তাৎপর্য শুধু সাংস্কৃতিক নয়—অর্থনৈতিক ও সামাজিক। দিনটি বাংলার কৃষকের, তাঁতশিল্পীর, কর্মকারের, মৃৎশিল্পীর, বাঁশ-বেতসহ বিচিত্র রকম কুটিরশিল্পীর, লোকশিল্পীর—ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণি–পেশার মানুষের। গ্রামবাংলার মানুষের অসামান্য সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় বাংলা নববর্ষে। বাংলার নন-ফরমাল অর্থনীতি যে কত বড়, অনবরত জিডিপির অঙ্ক কষেন যাঁরা, তাঁদের তা ধারণার বাইরে।

আবহমান কাল যাবৎ বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র কুটিরশিল্প। ভারী শিল্প বা রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প কারখানা সাম্প্রতিক সংযোজন। পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি চলে পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকে। ধারদেনা করে অনেকে কাঁচামাল কেনেন। কুটিরশিল্পের কারিগর-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। কর্মচারীদের অনেকে গ্রামের দরিদ্র নারী। মালামাল তৈরি হতে থাকে বছরজুড়ে। শুধু নববর্ষের কয়েক সপ্তাহ আগে শেষ করা হয়।

এবার নববর্ষ উদ্‌যাপন যে অনিশ্চিত, তা মার্চ মাসের আগে পর্যন্ত ধারণা করেননি কেউ। ফলে মৃৎশিল্পী ও বাঁশ-বেতের পণ্যের ব্যবসায়ীরা তাঁদের পুঁজিপাটা আগেই শেষ করে বসে আছেন। কাঁচামাল যদি বাকিতে এনে থাকেন, সে ঋণ শোধ করবেন কীভাবে? কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করবেন কীভাবে? দরিদ্র শ্রমিক ও মালিক উভয়েরই সংকট। তাঁরা তো ফরমাল ইকোনমির কেউ নন। সুতরাং রাষ্ট্র তাঁদের ‘প্রণোদনা’ দেবে কেন?

জনবহুল দেশ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পুষ্টিকর খাদ্য খাক বা না খাক, কাপড়চোপড়ের প্রতি আগ্রহটা বেশি। এবার নববর্ষ ও ঈদ কাছাকাছি সময়ে হওয়াতে তাঁতশিল্পের পণ্য বেশি বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে জন্য ওই ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগও বেশি হয়ে থাকবে। কিন্তু করোনা তাঁদের ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে, তা জীবাণুর আঘাতের চেয়ে কম নয়।

১২০-২৫ বছর আগের ঢাকার বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন সম্পর্কে জানা যায় প্রখ্যাত হেকিমি চিকিৎসক হাকীম হাবিবুর রহমানের স্মৃতিচারণা থেকে। তাঁর বাড়ি ছিল চকবাজারের এক গলির মধ্যে, তাঁর মৃত্যুর পর সেটির নামকরণ হয় ‘হাকীম হাবিবুর রহমান লেন’। তিনি লিখেছেন, চৈত্রসংক্রান্তির দিন দুপুর থেকে মেলা শুরু হতো ‘মসজিদগঞ্জের চরে’। তিনি লিখেছেন, লালবাগ নবাবগঞ্জের ওপাশেই ছিল কম বসতিপূর্ণ এলাকা ‘মোগলানীর চর’ এবং ‘মসজিদগঞ্জ চর’। একসময় এই দুই নাম মুছে গিয়ে পুরো এলাকাটির নাম হয় ‘কামরাঙ্গীরচর’। ফাঁকা ওই এলাকায় প্রচুর কামরাঙাগাছ ছিল। সেখানে বসত বৈশাখী মেলা। তিনি লিখেছেন, ‘এটি ছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মেলা। এখানে বেশির ভাগ মাটির খেলনা এবং মাটির বাসনপত্রের দোকান বসত। কোথাও শামিয়ানা টাঙানো হতো এবং সংগীতের জলসা বসত। সেখানে শহরের হিন্দু ও মুসলমান গায়কেরা নিজেদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করতেন। বেশির ভাগ “সঙ” বিভিন্ন মহল্লা থেকে আসত। তারা গান-বাদ্য করে মানুষকে আনন্দ দিত।’

হাকীম হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘মেলার দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ বাংলা সনের প্রথম দিন “চিলপূজা” নামে ফরিদাবাদ ও শ্যামপুরে মেলা বসত। আমার বাল্যকালে (১৮৯০ সালে) আমি দেখেছি যে ফরিদাবাদের থেকে বেশি বড় মেলা বসত শ্যামপুরে। শ্যামপুরে নাচের অনুষ্ঠান বেশি হতো, যা এখন (১৯৪৫ সালে) চোখেই পড়ে না।’ [ঢাকা পচস্ বরস্ পহেলে (ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে), কিতাব মঞ্জিল, লাহোর, ১৯৪৯]

পরিবেশবাদ শব্দটি এখন মানুষের মুখে মুখে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে ওই শব্দের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ছিল না, কিন্তু বাঙালি খুব ভালো পরিবেশবাদী ছিল। যাকে বলা হলো ‘চিলপূজা’, তা কোনো পূজা-প্রার্থনা ছিল না। ফরাশগঞ্জ শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গার তীরে প্রচুর চিল-গাঙচিল প্রভৃতি পাখি ছিল। পয়লা বৈশাখ ঢাকার মানুষ পাখিদের জন্য আকাশের দিকে ছুড়ে দিত রুটির টুকরা, ছোট মাছ ইত্যাদি। তারই নাম ‘চিলপূজা’। নতুন বছরে পশুপাখিকে খাইয়ে বাঙালি আনন্দ পেত।

অনেকের ধারণা, লোকসংস্কৃতি ও বৈশাখী মেলা গ্রামগঞ্জের ব্যাপার। আসলে তা নয়। নগরেও লোকসংস্কৃতি ছিল। তা আধুনিক নাগরিক সংস্কৃতির আগ্রাসী তৎপরতায় হারিয়ে গেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা বোঝে বাংলা নববর্ষ রাজধানীর মহাসড়কে গেঞ্জি বা পাঞ্জাবি পরে বিশাল শোভাযাত্রা। সত্তর ও আশির দশকে শুরু হয়েছিল পান্তা-ইলিশের তামাশা। বাঙালির চিরকালের নববর্ষ উদ্‌যাপনের বৈশিষ্ট্য হারাতে থাকে। আধুনিক সংস্কৃতিজীবীদের প্রকাণ্ড সব কর্মকাণ্ড দেখে রায়েরবাজার, মিরপুর ও ধামরাইয়ের কয়েকজন মৃৎশিল্পী আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা যামু কই? পয়লা বৈশাখটাও আপনেরা ছিনতাই করলেন। অহন ভাত না খাইয়া মরা ছাড়া আর কোনো পথ নাই।’

লোকসংস্কৃতি যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্যই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর করেছিলেন এবং কয়েক দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করেন। সেখানে সারা দেশের গ্রামীণ কুটিরশিল্পের দ্রব্যাদি প্রদর্শিত ও বেচাকেনা হয়। এবারই হলো না।

বৈশাখী মেলা সারা দেশে অসংখ্য জায়গায় হতো। প্রতিটি জায়গার মেলার নিজস্ব চরিত্র ছিল। যে এলাকায় যে পণ্য বেশি তৈরি হয়, সেসব পণ্য মেলায় আসে বেশি। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাপট সত্ত্বেও আজও বাংলাদেশে হস্তশিল্পের কদর কম নয়। বৈশাখী মেলার অর্থনৈতিক ভূমিকা বিরাট।

শিশু-বুড়ো সব বাঙালিই মিঠাই পছন্দ করে। দেশের একেক এলাকায় একেক ধরনের মিঠাই বেশি প্রচলিত। ছানার মিষ্টির বাইরে গ্রামীণ এলাকায় শুকনা চিনি-ময়দার মিষ্টিও অনেক রকম। অমৃতি-জিলাপি তো আছেই, চালকুমড়ার মোরব্বা, নারকেলের বরফি, তিলের খাজা, শনপাপড়ি, গজা, নকুলদানা, মোয়া, মুড়কি, চিনির সাজ প্রভৃতি প্রস্তুতের সঙ্গে দশ-বারো লাখ মানুষ জড়িত। সেটাই তাঁদের জীবিকা। হাটবাজার বন্ধ থাকায় এবং মেলা না হওয়ায় তাঁরা উপার্জনহীন।

করোনার প্রকোপ প্রশমিত হলে জনজীবন স্বাভাবিক হবে। বৈশাখী মেলা না হলেও আশা করব গ্রামীণ কারুশিল্পীরা আর্থিক কষ্টের মধ্যেও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবেন। এবারের ক্ষতি যেন আগামীবার পুষিয়ে নিতে পারেন, এই কামনা করি। বাংলা নতুন বছরটি সবার জন্য শুভ হোক।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক