করোনার টিকা ব্যবস্থাপনা: দশে দশ

করোনাভাইরাসর টিকা
প্রতিকী ছবি


আজ ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে করোনার টিকা নিতে গিয়ে আমি তো হতবাক! এমন চমৎকার ব্যবস্থা কল্পনাও করিনি। আমার সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে ভাবলাম, দেখি তো কী হয়? একটি টেবিলে তিন-চারজন কর্মী কাজ করছেন। আমার অনলাইনে করা রেজিস্ট্রেশন কার্ড দিলাম। চট করে কর্মীরা তাঁদের ফাইলে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখে পাঠিয়ে দিলেন ৬ নম্বর বুথে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডাক এল। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স আমাকে বললেন, কিছু না, টেরই পাবেন না। এই তো হয়ে গেল। তারপরই বললেন, হয়ে গেছে। বাইরে আধঘণ্টা বসে তারপর যেতে পারেন।

আমি তো অবাক। ত্বকে কখন সুই ফোটানো হলো টেরই পাইনি। এত সরু সুই আমি আগে কখনো দেখিনি। আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় অন্তত কয়েক শ বার ইনজেকশন দিয়েছি। প্রতিবারই একটু চোখ বন্ধ করে, দম আটকিয়ে ব্যথা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম, ইনজেকশন কখন নিলাম, টেরই পেলাম না।

ভাবছিলাম কতই না অব্যবস্থাপনা দেখব। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু কিছু না। প্রশস্ত হলঘর। আট-দশটি বুথ। প্রতিটি বুথের সামনে বসার আসন। আসুন, বসুন, ইনজেকশন নিন, ব্যস, এবার নিশ্চিন্তে চলে যান। এ তো ভাবাই যায় না।
টিকা নিতে আসছেন মানুষ। আবার যত জনের ব্যবস্থা, প্রায় সমানসংখ্যক মানুষ আসছেন। কোনো চেয়ার ফাঁকা নেই, আবার উপচে পড়া ভিড়ও নেই। দুই মিনিটে ইনজেকশন শেষ, ২০-৩০ মিনিট বসে বিশ্রাম। মানুষ আসছেন আর যাচ্ছেন।

এত চমৎকার ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের দক্ষতা সত্যি এক রেকর্ড। এর আগে আমরা দেখেছি করোনার সোয়াব টেস্টের জন্য কিছু ভুয়া ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে। হাজার হাজার টাকা নিয়ে মানুষকে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে একটা বার্তা দিয়েছে যে এ ধরনের অপকর্মের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
সরকার এবার টিকার ব্যাপারে বেসরকারি ভুয়া ক্লিনিকের কারসাজি বন্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়তো কিছুদিন পর বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিককে সুযোগ দিতে পারে। সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু জালিয়াত চক্র যেন কোনোভাবেই ঢুকে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

মানুষ যেন প্রতারিত না হয়। হাজার হাজার টাকা লাগবে, আবার পরে হয়তো দেখা যাবে করোনার নকল ইনজেকশনের ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে! এ ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্তের আগে নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, সরকার এসব বিষয়ে সচেতন।

প্রথম দিকে মানুষ কিছুটা দ্বিধায় ছিল। টিকা নিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছিল। কিন্তু এখন তো মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই টিকা নিচ্ছেন এবং সুস্থই আছেন। তাঁরা সবাইকে টিকা নিতে বলছেন। তাই মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস নির্মূল করতে টিকার বিকল্প নেই। মানুষ তো মরবেই, অর্থনীতিও ভেঙে পড়বে। তাই সরকার যে প্রথম থেকেই টিকা কেনার ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা ছিল সময়োচিত উদ্যোগ। এ না হলে দেশে সারা বছর করোনার বিপর্যয় ঘুরেফিরে চলত।

টিকা ছাড়া শুধু সাধারণ চিকিৎসায় এই ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচা কঠিন। আমরা তো দেখলাম আমাদের সহকর্মী, যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, সংবাদের সম্পাদক মুনীরুজ্জামানসহ কত সিনিয়র সাংবাদিক, চিকিৎসক, অধ্যাপকসহ অগণিত সাধারণ মানুষ কত অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করলেন। এভাবে চললে অন্তত দুই বছরে অগণিত মানুষের রোগ-শোক-মৃত্যুর পর হয়তো করোনাভাইরাসে ‘হার্ড-ইমিউনিটি’ অর্জন করা সম্ভব হতো। কিন্তু সেটা হতো সবচেয়ে অমানবিক একটা ব্যাপার। সরকার যে সেটা বুঝে সময়োচিত উদ্যোগ নিয়েছে, তা এক সাংঘাতিক সুবিবেচনার পরিচয়।

এখন আমাদের দেখতে হবে যেন দেশের অন্তত ৮০-৮৫ ভাগ মানুষ টিকা নিয়ে করোনামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। এ জন্য সরকারের উদ্যোগই হবে মূল। দেশের অন্তত ১৩-১৪ কোটি মানুষের টিকার ব্যবস্থা করা দরকার। এ জন্য টাকা লাগবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিল গেটসসহ অনেক ব্যক্তি টিকার ব্যবস্থা করার জন্য হাজার হাজার কোটি ডলার দান করেছেন। অনুন্নত দেশে বিনা পয়সার ব্যবস্থা করার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ রয়েছে। আমাদের দেশের শিল্পপতিরাও নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য বিনা পয়সায় টিকার ব্যবস্থা করার জন্য সীমিত পর্যায়ে হলেও উদ্যোগ নিতে পারেন।

একবার টিকা নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে হবে। প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার ১০ দিন পর মাত্র ৫২ ভাগ ইমিউনিটি অর্জিত হয় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তিন-চার সপ্তাহের মধ্য প্রায় ৯৫ ভাগ ইমিউনিটি নিশ্চিত। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার দিন দশেকের মাথায় মোটামুটি করোনাপ্রতিরোধী হওয়া সম্ভব। তাই প্রথম টিকা নেওয়ার পর আগের মতোই সবাইকে মাস্ক পরে চলাফেরা করতে হবে। এটা যতটা না নিজের নিরাপত্তার জন্য, তার চেয়ে বেশি অন্যদের সংক্রমণমুক্ত রাখার জন্য। কারণ, করোনার টিকায় নিজে রোগপ্রতিরোধী হলেও শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্যদের করোনায় সংক্রমিত করতে পারে। তাই অন্তত আরও বেশ কয়েক মাস, অন্তত এই বছরটা মাস্ক পরা অব্যাহত রাখা জরুরি।

কেউ যেন ভাববেন না, আমাদের এলাকায় করোনা নেই, টিকার দরকার কী? না, এটা ভুল। আজ হয়তো নেই, কিন্তু কাল করোনা এসে যাবে। গ্রামের পর গ্রাম ছারখার হয়ে যেতে পারে। তাই করোনার টিকা উপেক্ষা করা যাবে না। অন্তত ১০ বছরের বেশি বয়সের সবাইকে করোনার টিকা নিতে হবে। পর্যায়ক্রমে সে ব্যবস্থা সরকার করবে, এটাই আমরা চাই।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক।
quayum.abdul@gmail. com