করোনার দিনগুলোতে বই

পছন্দের বই কিনতে অমর একুশে বইমেলার একটি স্টলে ক্রেতারা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

করোনাভাইরাসের বিস্তার দেশে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। সরকারি হিসাবে দৈনিক মৃত্যু অর্ধশতাধিক। হাজার হাজার মানুষ রোজ সংক্রমিত হচ্ছেন। দূরে যেতে হবে না, আমার অফিসে যে ফ্লোরে আমি বসি, সেখানে একে একে পাঁচজন করোনা পজিটিভ। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে করোনা পজিটিভ। কোভিড-আক্রান্ত নিকটাত্মীয়র জন্য হাসপাতালে বেড খুঁজে জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছি। কোনো হাসপাতালেই আর বেড খালি নেই। আইসিইউ তো ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় আঘাতটা বাংলাদেশে বেশ ভয়াবহ হয়েছে।

এর মধ্যে বইমেলায় গিয়েছিলাম একদিন। এত সুন্দর আয়োজন। আর বসন্তের বাতাস শরীর-মন জুড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে খবর হলো, মেলার সময় কমিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত করা হয়েছে, ছয়টার পর গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রকাশকেরা ঠিক কথা বলেছেন, এর চেয়ে মেলা বন্ধ করে দিলেই হয়। কারণ, মানুষ আসেই ছয়টার দিকে, ঘুরে ঘুরে বই কিনতে কিনতে কমপক্ষে রাত আটটা, বেরোতে বেরোতে সাড়ে আটটা, নটা। বেলা সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত মেলা খোলা রাখার কোনো মানে হয় না। স্টল বা প্যাভিলিয়ন চালানোর জন্য যে কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের পারিশ্রমিকের খরচই ওই অসময়ের বিক্রিতে উঠবে না।

করোনার প্রকোপ বিবেচনায় বইমেলার সময়-পরিধি কমিয়ে আনা যুক্তিযুক্ত নয়। ধরা যাক, একটা ঘরে ১০ জন আসবেন। এই ১০ জনকে আমরা একই সঙ্গে ওই ঘরে থাকতে দেব, নাকি একের পর এক। যদি প্রত্যেককে এক মিনিট করে ওই ঘরে থাকতে দিই, তাহলে সময় দিতে হবে ১০ মিনিট। আর যদি বলি, এক মিনিটেই ১০ জনকে সারতে হবে, তাহলে ১০ জন একই সঙ্গে ঘরটাতে ঢুকবেন। এভাবে সময়-পরিধি কমানো মানে একই সঙ্গে বেশি মানুষকে এক জায়গায় জড়ো হতে বাধ্য করা। বইমেলা সন্ধ্যার পরে বন্ধ, কারণ করোনা—এটা শুনে মনে হচ্ছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা বাংলা একাডেমি জেনে গেছে এক গোপন আবিষ্কার, সন্ধ্যার পর করোনা ছড়ায়, দিনের বেলা করোনা ছড়ায় না।

১ এপ্রিলের প্রথম আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ একটা সুচিন্তিত কলাম লিখেছেন, শিরোনাম ‘সর্বাত্মক বা আংশিক কোনো লকডাউনই বাস্তবসম্মত নয়’। আমাদের দেশের বাস্তবতায় লকডাউন অসম্ভব। আমরা মিলেমিশে দলা পাকিয়ে বসবাস করি। আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রত্যেকে নিজস্ব গাড়িতে আলাদা আলাদা করে চলি না, নিজস্ব বাড়িতে দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকি না। আমাদের কৃষককে খেতে যেতেই হবে, কৃষকবধূকে হাঁস-মুরগি, বাগান-ঘরকন্না করতেই হবে। আমাদের গার্মেন্টসকর্মীদের কাজে যেতেই হবে। রিকশাওয়ালা-সবজিওয়ালাকে বের হতেই হবে। সৈয়দ আবদুল হামিদ লিখেছেন, হাত ধোয়া আর মাস্ক পরার ওপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। সব ধরনের সভা-সমাবেশ—রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক—নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি চিকিৎসা-সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কতগুলো সুপারিশ করেছেন।

আর টিকার সরবরাহ এবং টিকাদানের কর্মসূচি যাতে অব্যাহত থাকে, কোনো বিরতি না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

গত বছর বহুদিন ঘর থেকে বের হইনি। ওই সময় যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের অনেকেই ঘর থেকে বের হতেন না। তারপর ডাক্তাররা বলতে শুরু করলেন, একদম বের না হওয়ার চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অল্পস্বল্প বের হওয়া ভালো, তাতে রোগ প্রতিরোধক শক্তি বাড়ে। আসলে করোনা নিয়ে চূড়ান্ত কথা হলো, করোনা নিয়ে চূড়ান্ত কথা আমরা জানি না। শুধু এই জানি, গার্মেন্টস কারখানাসহ আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খোলা রাখার বলিষ্ঠ কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। আমরা দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম।

মার্চে করোনার প্রকোপ বাড়ার বৈজ্ঞানিক কারণ বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। এটা কি ইউরোপ থাকা আসা নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের কারণে হচ্ছে, নাকি বাতাসে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার জন্য হচ্ছে, নাকি আমরা স্বাস্থ্যবিধি ভুলে একবারে বেরিয়ে পড়েছিলাম বলে হচ্ছে? তবে আমরা যে আক্রান্ত হচ্ছি এবং আমাদের মৃত্যুসংখ্যা যে বেড়ে গেছে, তা উদ্বেগজনকভাবে সত্যি।

প্রকাশকেরা সারা বছর মন্দার ভেতর দিয়ে গেছেন। সেই ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ থেমে আছে প্রায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বই কিনবে কে? ক্ষতি তো পোষানো যাবে না, কিন্তু বইমেলাটা যদি ভালোভাবে হতো, নতুন বছরে হয়তো একটু বেঁচে থাকার এবং এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাওয়া যেত। মেলা টাকা খরচ করে প্রকাশকেরা প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছেন, সেই সাজানোর খরচ এবারের বইমেলা থেকে উঠবে না। সরকারের উচিত হবে, দেশের স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরির জন্য বই কেনা। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ২৫০ কোটি টাকার বই কিনে পাঠাগারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলে সবদিক থেকে ভালো হবে। ২৫০ কোটি টাকার বই কেনা হলে ২৫০ প্রকাশক গড়ে এক কোটি টাকা করে বই বিক্রি করতে পারবেন। তাঁদের লাভ থাকবে ১৫ লাখ টাকা করে। এই ১৫ লাখ টাকা দিয়ে তাঁরা সারা বছরের দোকানভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি দিতে পারবেন।

কিন্তু বই না পড়েই কি একটা প্রজন্ম বড় হবে? বঙ্গবন্ধু দেশটাকে স্বাধীন করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি কবিতা পড়তেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’ আবৃত্তি করতেন জেলখানায়, আর পশ্চিম পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে গাড়িতে উঠে পাকিস্তানি নেতাদের শুনিয়েছেন নজরুলের কবিতা। জেলে বসে পড়তেন নানা ধরনের বই, চিঠিতে লিখতেন তাঁকে যেন বই পাঠানো হয়। ১৮ জুন ১৯৬৬ কারাবন্দী শেখ মুজিব লিখেছেন:

এমিল জোলার লেখা তেরেসা রেকুইন পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র—জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই-তিন ঘণ্টা সময়।

বই না পড়লে অর্থনৈতিক উন্নতি দিয়ে লাভ নেই। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একটা করে ভালো মানুষ এবং একটা করে দানব থাকে। বই মানুষের ভেতরের ভালো মানুষটাকে বড় করে তোলে, দানবটাকে অপসারিত করে। বই না পড়ে যদি আমরা বড় হই, আমাদের ভেতরের দানবেরা সবকিছু তছনছ করে দেবে।

তবে করোনার বিস্তারও ঠেকাতে হবে। তা করতে আমাদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শই শুনতে হবে। আমি শুধু রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ থেকে বলতে পারি, ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’

নিজের সুরক্ষা নিজের কাছে। মাস্ক পরে থাকতে হবে, হাত ধুতে হবে, ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে, কোনো মানুষের বদ্ধ জায়গায় অন্যের কাছাকাছি বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। নিজেকে ঢাকাই ভালো, ধরণি ঢেকে রাখার সামর্থ্য, ক্ষমতা, বাস্তবতা—কোনোটাই আমাদের দেশে নেই।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক