করোনার সময়ে ভর্তি বিড়ম্বনা

গোটা পৃথিবী ন্যানোমিটার দীর্ঘ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এই যুদ্ধের শেষ এখনো দৃষ্টিসীমানার ভেতরে নেই। রোগের ক্ষেত্রে নিরাময়ের তুলনায় প্রতিরোধ শ্রেয়তর। করোনার ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরিধান করা প্রতিরোধের হাতিয়ার। পৃথিবীর গড় জনঘনত্বের ২৪ গুণ বেশি জনঘনত্ব নিয়ে বাংলাদেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ। এরপরও বলতে হয়, ইউরোপসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো আমরা মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের সরকার মার্চ মাসেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। তবে একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার কার্যক্রমে যুক্ত রাখার জন্য টেলিভিশন ছাড়াও শিক্ষকেরা অভিভাবকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ধারাবাহিকতায় রাখতে পারলে শিক্ষার ক্ষতি এতটা হতো না। উপরন্তু করোনাকালে যখন আমাদের দৈনন্দিন শিক্ষা কার্যক্রম চালু নেই, আমাদের পড়াতে হচ্ছে না, পরীক্ষা নিতে হচ্ছে না, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত ছিল শিক্ষার নানা সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।

কবিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শুধু পরীক্ষার্থী নয়, তাঁদের অভিভাবকদের জন্যও বড় দুর্ভোগের কারণ, সঙ্গে দেশের জন্যও। স্কুল-কলেজে ভর্তির বিষয়টিও সঙ্গে রয়েছে। সুখের বিষয় এই, অন্তত এইচএসসি পর্যায়ে সরকার অনলাইন ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু করার ফলে বিশাল ভোগান্তি থেকে সংশ্লিষ্ট ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা পরিত্রাণ পেয়েছেন। অন্যান্য শ্রেণিতে ভর্তির সমস্যা রয়ে গেছে। এর মধ্যে সরকার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি লটারির মাধ্যমে করায় কোমলমতি শিশুরা নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থেকে মুক্তি পেয়েছে। তা–ও সমাধানটি আংশিক; কারণ, তাদের অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির লটারি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়। একই শিশুর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ হলে যত দিন না তারা একটি স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত অনিশ্চয়তা কাটে না। ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরের অভিভাবকেরা শহরভিত্তিক স্কুলগুলোর ভৌগোলিক এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় এনে পছন্দের ক্রমে স্কুলগুলোর নাম সাজিয়ে আবেদন করলে একটি লটারির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে ভর্তির ব্যবস্থা করা যায়। অন্যান্য শ্রেণির ফাঁকা আসনগুলো পরীক্ষা না নিয়েই আগের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির অনুরূপ একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব।

উন্নত, উন্নয়নকামী—প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বিদ্যমান। আমাদের তা না পারার কারণ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির বিষয়ে আমাদের আরও আন্তরিক, কার্যকর ও সম্মিলিতভাবে ভাবতে হবে। সুখের বিষয়, তুলনামূলকভাবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষায় সম্মত হয়ে দেশ ও জাতির প্রতি তাদের শ্রেয়তর দায়বদ্ধতা এবং অঙ্গীকার প্রমাণ করেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিগত বছর থেকে মেডিকেল কলেজগুলোকে অনুসরণ করছে। আমরা জানি, বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভর্তি পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হোক, তা চায় না। এ–ও জানি, একসময় ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজও চায়নি। কিন্তু তারা তাদের সহকর্মীদের প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছে, যার ফলে মেডিকেলে ভর্তি দুর্ভোগহীন হয়েছে। এখনো যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একযোগে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে আস্থা স্থাপন করতে পারছে না, রাষ্ট্রপতির উপদেশ, অনুরোধ রক্ষা করতে পারছে না, আশা করি কমপক্ষে দুর্ভোগের মাত্রা কমিয়ে পরীক্ষার সংখ্যা যত কম করা যায়, এ বিষয়ে তারা সচেষ্ট হবে।

করোনাকালে যখন আমাদের দৈনন্দিন শিক্ষা কার্যক্রম চালু নেই, আমাদের পড়াতে হচ্ছে না, পরীক্ষা নিতে হচ্ছে না, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত ছিল শিক্ষার নানা সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করা

রাজধানীর অসহনীয় যানজট বিবেচনায় এনে সরকারকে ভাবতে হবে, কীভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের বসবাসের এলাকার স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে পারে, এ জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ করা। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য সরকারের নীতিমালা অনুসরণ করেই সবাই ভর্তি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। এমনকি আমাদের পাশের দেশেও এ রকম নিয়ম চালু রয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও বাসস্থানের কাছের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে ভর্তির নিয়ম রয়েছে এবং নিয়মগুলো পালনের ফলে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারও তেমন ক্ষুণ্ন হচ্ছে না। তাহলে আমাদের অসুবিধা কী?

এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, দেশ দীর্ঘদিন ধরে হরতাল ও নৈরাজ্যকর তৎপরতা থেকে মুক্ত। এমন সময় ছিল, শিক্ষার্থীরা ১০ মাইল রাস্তা যানজটের মধ্যে পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জানত, ক্লাস হবে না। এ রকম আমাদের তরুণ প্রজন্মের কত কোটি ঘণ্টা যে অপচয় হয়েছে, তার হিসাব আমরা কখনো রাখি না। অথচ হংকং শহরের একটি মেট্রো লাইন পাথরের পাহাড় এড়িয়ে আয়তক্ষেত্রের তিন বাহু বরাবর যাওয়ায় প্রতি ভ্রমণে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় বেশি লাগায় যাত্রীপ্রতি দিনে কতবার তাকে বছরের দিন সংখ্যা দিয়ে গুণ করে তাকে আবার ১০/২০ বছরের জন্য গুণ করে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা যখন তা হিসাব করে দেখালেন, তখন পাথরের পাহাড় ভেদ করে রাস্তা তৈরি করে সরকার প্রমাণ করল, নাগরিকদের ৩০ সেকেন্ড দেশের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। আর এতে নাগরিকেরাও আরও দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত হলো।

আশা করি আমাদের দেশসহ গোটা পৃথিবী করোনার অভিশাপ থেকে অচিরেই মুক্তি পাবে। তবে ঢাকা শহরের বাসিন্দারা যে অচিরেই যানজটের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে, এটা চরম আশাবাদী কেউই বিশ্বাস করবে না। এগুলোকে বিবেচনায় রেখে প্রতিটি স্কুল-কলেজ যদি আংশিকভাবে হলেও পড়ালেখার কার্যক্রম অনলাইনে করতে পারে, তাহলে যানজটের উপশম হতে পারে, অন্তত শিক্ষার্থীদের রাস্তায় থাকার সময় কমানো যেতে পারে।

অনেক দিন পর আবার বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল। আমার এক বন্ধুবর বলেছিলেন, কানাডাতে আদি অধিবাসীরা সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে রেললাইন উপড়ে ফেলেছিল। সরকার খুবই শক্ত হাতে অনুকরণীয় শাস্তি দেওয়ার ফলে আর তা হচ্ছে না। জাতীয় কিংবা অন্যের সম্পদ নষ্ট করা কোনোক্রমেই কোনো রকম ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা হতে পারে না। ক্ষোভ প্রকাশের মূল্যবোধসম্পন্ন পদ্ধতি শিশু-কিশোরেরা অনুসরণ করে। তারা অসন্তুষ্ট হলে না খেয়ে থাকে, কাপড়-জুতা পছন্দ না হলে তা না পরে থাকে, খেলতে যায় না, আনন্দ করে না। আমরা তাদের অনুশীলন করে শ্রেয়তর পথ অনুসরণ করতে পারি।


মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক িবশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো