করোনায় শহুরে জীবনের ভবিষ্যৎ কতটা হুমকিতে?

করোনাকালে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মতো ফাঁকা রাজধানীর অনেক সড়ক (সাম্প্রতিক ছবি)
করোনাকালে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মতো ফাঁকা রাজধানীর অনেক সড়ক (সাম্প্রতিক ছবি)

ঈদেরকালে করোনার মধ্যেই মৃত নগরজীবন নড়েচড়ে উঠেছে। ভাইরাসের বিস্তার ও ভীতি কমলে আরও প্রাণ পাবে। কিন্তু করোনা পরের নগরজীবন বহুকাল আর আগের মতো হবে না। পরিবর্তন আসবে অবকাঠামোতে, বেশি বদলাবে সামাজিক সম্পর্ক। সেসব নতুনত্ব নিয়ে ভাবা দরকার। নগর ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আসতে হবে।

মহামারি মাত্রই নগরবিরোধী। অতীত তাই বলে। যে শহরের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ বেশি, তারাই মহামারিতে বেশি ভোগে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কোভিড-১৯–এর যাত্রা এক শিল্পনগরী থেকে। ছড়িয়েছেও বেশি নগরে নগরে। অসুস্থ এবং মরছেও বেশি শহুরে মানুষ।

১৯২০-এ স্প্যানিশ-ফ্লুর সময় বিশ্ব জনসংখ্যার ১৪ ভাগ ছিল শহরে। ২০২০-এ এই হিস্যা ৫৫ ভাগের বেশি। কোভিড-১৯–এর প্রায় ৮০ ভাগ শিকার শহরবাসী। বাকিদেরও শহুরেরা সংক্রমিত করেছে। মেগাসিটিগুলোর পরিবেশ পুরোই অস্বাভাবিক এখন। নগরজীবনের গ্ল্যামারে এটা বড় এক ধাক্কা।

এর কারণ স্পষ্ট। ভাইরাসমুক্ত থাকার জন্য সামাজিক অবকাঠামো যেমন হওয়া উচিত, নগরগুলোর অবকাঠামো ঠিক তার বিপরীত ধাঁচে তৈরি ছিল। ডেঙ্গুর মতো মহাসংকটও শহুরে অবকাঠামোর ধরন থেকে সৃষ্ট। একই সূত্রে পেয়েছি আমরা শ্বাসযন্ত্রের রোগবালাই। যক্ষ্মার মতো সংকট। শহুরেদের চোখে চশমার আধিক্যও একই কারণে।

শিগগির সবুজের খোঁজে বের হবে মানুষ

বড় সংকট মাত্রই মানুষ বাধ্য হয় জীবনধারা পাল্টাতে। করোনাকালে নগরজীবনে সামাজিক সম্পর্ক এরই মধ্যে অনেক পাল্টেছে। মানুষের ঘরে থাকার প্রবণতা বেড়েছে। দুর্যোগ কমলেও সে অভ্যাসের অবশেষ থাকবে। আরও বহুদিন সতর্ক মানুষ শরীরী সম্পর্কে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। তারা ‘প্রাইভেট এরিয়া’ খুঁজবে—‘পাবলিক স্পেস’ এড়িয়ে। ক্রমে এটা সাংস্কৃতিক পছন্দ হয়ে উঠবে।

কোনো জনপদে মানুষ যখন অপর সবার সামাজিক সম্পর্ক এড়াতে চায় এবং এই অস্বস্তি যখন কোটি কোটি জনে সঞ্চারিত হয়, তখন সেটা আর মানবিক পরিবেশ থাকে না। ঢাকার মতো মেগাসিটিগুলো সেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

যানজট কমাতে একসময় প্রাইভেট কারের বদলে পাবলিক বাসকে সমাধান ভাবা হচ্ছিল। করোনা বাড়াতে পারে হাঁটা ও সাইকেলের আধিক্য। পথচলায় শারীরিক দূরত্বের ভালো সমাধান সাইকেল। নতুন করে বাড়বে প্রাইভেট কারের প্রতি পক্ষপাতও। সেটা ডেকে আনতে পারে বাড়তি নগর যন্ত্রণা।

তবে অনেকেই বাইরের বহু কাজ ভবিষ্যতে ঘরেই সারতে চাইবে। এ ইচ্ছা পরবর্তী প্রজন্মেও সংক্রমিত হতে পারে। ঘরে দাপ্তরিক কাজের অভ্যাসের কারণে ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর নকশায়ও পরিবর্তন আসবে। রাস্তায় ভিড়-বাট্টা কমবে। মানুষ বেশি করে ‘লোকাল’ হতে চাইবে। আগের মতো দূরের পথে হুটহাট বেরিয়ে পড়বে না। সুপার মার্কেট আর সিনেমা হলের জন্য ভবিষ্যৎ তাই সুখের নয়। খোলামেলা পরিসরের স্থানীয় ‘খুদে মার্কেটে’র দিকে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। কেউই নিশ্চিত নয় রাস্তার পাশের খাবার দোকানগুলো আবার জমবে কি না, চুলকাটার দোকানে কবে ভিড় লাগবে, গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ আবার গান শুনতে বসবে কি না। এসবের ঘরোয়া সমাধান খুঁজবে মানুষ। তাতে যাত্রীর চাপ কমতে পারে রাস্তায়।

তবে নিশ্চিত যে করোনার প্রকোপ কমতেই সবুজের খোঁজে বের হবে মানুষ। জলাশয় দেখতে চাইবে। পার্ক খুঁজবে। ভাইরাসমুক্ত পৃথিবীতে শহুরে মানুষের কাছে এসবের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। নগর মানে কেবল কিছু দালানকোঠা নয়, প্রচুর উদ্যান, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্রও চাই তাতে—সেই বার্তাই দিল করোনা। তবে এসবের জন্য দূরে যেতে চাইবে না বাসিন্দারা। প্রত্যাশা করবে নগরগুলোর ভেতরেই খোলা জায়গা থাকুক।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার প্রথম দফায় ছুটি ঘোষণার পর গ্রামের বাড়ি ফিরতে কমলাপুর রেলস্টেশনে মানুষের ভিড়। (ফাইল ছবি)
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার প্রথম দফায় ছুটি ঘোষণার পর গ্রামের বাড়ি ফিরতে কমলাপুর রেলস্টেশনে মানুষের ভিড়। (ফাইল ছবি)

স্বাস্থ্যপ্রশ্ন বাদ দিয়ে নগর পরিকল্পনার দিন ফুরাল

গত শতাব্দীর কলেরা মহামারি বিশ্বের বহু শহরে মাটির নিচের নর্দমা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে। ঘরবাড়ি তৈরিতে আলো-বাতাসের বিধিবিধানও চালু হয় শিল্পদূষণে শ্বাসকষ্টে বহু মৃত্যুর পর। চলতি লকডাউন যত কমে আসবে, মানুষের ততই পক্ষপাত বাড়বে অক্সিজেনের জন্য। আগের মতো আর রেস্তোরাঁকেন্দ্রিক হবে না নগর বিনোদন। অতি ধনীরাও প্রমোদতরি ও তারকা হোটেলে অস্বস্তি বোধ করবেন।

শহরগুলোর গাছগাছালি ঘেরা চত্বর এ রকম সবার জন্য বিকল্প হতে পারে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা পার্ক ও খোলা জায়গার ধরন কেমন হতে পারে, সেটা নিয়ে ইতিমধ্যে নগরবিদরা বেশ কিছু মডেল তুলে ধরেছেন। বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় খোলা জায়গার যে ঘাটতি রয়েছে, তা শোধরানোর সময় এখনই। করোনার সময় সব চিকিৎসক ভিটামিন ডির জন্য রোদ লাগাতে বলতেন। কিন্তু ঢাকায় নির্বিঘ্নে গায়ে রোদ লাগানোর জায়গা কম। নেই বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়ার সুযোগও।

ইতিমধ্যে বলা শুরু হয়েছে, করোনা বিশ্বজুড়ে স্থাপত্যবিদ্যায় আনতে চলেছে আমূল পরিবর্তন। নগর পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যপ্রশ্নকে বাদ দিয়ে শুধু অর্থনীতি ও শিল্পকে গুরুত্ব দেওয়ায় বিস্তর শাস্তি ভোগ করল বিশ্ব। নিউইয়র্ক ও লন্ডনের মতো বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র কিংবা উহান, ডেট্রয়েট বা উত্তর ইতালির মতো শিল্পকেন্দ্রে একই পরিণতি দেখা গেল।

আমাদের জন্য একটা অগ্রাধিকার অন্তত স্পষ্ট। ঢাকা-চট্টগ্রামে বিমানবন্দরের আশপাশে প্রবাসীদের লক্ষ্য করে বিশাল আয়তনের স্বাস্থ্যকেন্দ্র দরকার। করোনা নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকদের কাছে ইতিমধ্যে এই আরজি পেশ করে রেখেছে।

অর্থনীতিকে শহরের বাইরেও ছড়াতে হবে

করোনার প্রথম ধাক্কায় যানবাহনকর্মী, রাস্তার খাবার বিক্রেতা, হকার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র দোকানিদের একাংশ ইতিমধ্যে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। করোনাকালের শহুরে অভিজ্ঞতা তাঁদের চিরজীবনের এক তিক্ত স্মৃতি হয়ে থাকল। অনেকে পুরোনো কাজের ধরনে ফিরতে পারবেন কি না, দ্বিধায় আছেন।

তাঁদের একাংশ যদি গ্রামেই থেকে যেতে চান, তাঁদের জন্য সেখানে কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাঁরা নিজেরাও সে চেষ্টায় নামবেন। করোনা–পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন অনেক সৃজনশীল উদ্যোগ দেখা যাবে। শহর থেকে যাওয়া এই মানুষদের গ্রামে ধরে রাখার সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে সরকারের অনেক বিভাগ ও এনজিওগুলো। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, ঋণ ও বিপণন সুবিধা পেলে করোনাকালে গ্রামে যাওয়া এই মানুষদের আর শহরের গিঞ্জি শহরতলিতে না এলেও চলবে। কেবল শহরকে ঘিরে জাতীয় অর্থনীতি গড়ার ঝুঁকি বিশ্ব এবার ভালোই টের পেয়েছে। এই শিক্ষা আমাদের সংশোধন দাবি করছে।

করোনা সংকটের শুরুতে শহরগুলোতে কৃষিপণ্যের আগমনে সংকট দেখেছে সবাই। শহরের সঙ্গে আশপাশের গ্রামীণ জনপদের সুসংগঠিত সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় এটা হয়েছে। শহর-গ্রাম পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাটি উভয় দিক থেকেই অগোছালো। গ্রামীণ উৎপাদক ও শহুরে ভোক্তা উভয়ের অসুবিধা তাতে। আধুনিক নগরকে শিগগির এই সংকটের সুরাহা করতে হবে।

শহর ছেড়ে গ্রামে অবস্থান নেওয়া মানুষদের দিয়েই কৃষিপণ্যের নতুন নতুন সাপ্লাই চেইন গড়া সম্ভব। এই মানুষেরা গ্রাম-শহর দুই দিকই ভালো জানেন। সাপ্লাই চেইন ও পাইকারি বাজারের বহুমুখীকরণ কৃষিকে লাভজনক করে তুলবে। ফলে গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়বে। শহরগুলোর চারপাশে আরও অনেক পাইকারি বাজার প্রয়োজন। এত বড় শহরগুলো মাত্র তিন-চারটি করে বড় আড়তের ওপর নির্ভর করে আছে, যা বিপজ্জনক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনার শনাক্তের পরীক্ষা চলছে। (ফাইল ছবি)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনার শনাক্তের পরীক্ষা চলছে। (ফাইল ছবি)

নগর ব্যবস্থাপনায় লাগবে বিপুল তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান

ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় বড় বড় শহরগুলোতে লকডাউনের প্রতিক্রিয়ায় কী ঘটবে, সেটা শুরুতে বোঝা যায়নি। বাসিন্দাদের শ্রেণি, পেশা, সংখ্যা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ছিল না। ফলে অনেক সিদ্ধান্তে দোদুল্যমানতায় ভুগতে হয়েছে। কোন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া কত মানুষের ওপর কীভাবে পড়বে, তার কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করা যাচ্ছিল না।

নগর ব্যবস্থাপনার জন্য এই ‘বিগ-ডেটা’ দরকার। নগর যত বড় হবে, সেখানে কাজ করতে আসা মানুষ সম্পর্কে এলাকাভিত্তিক বড় আকারের ‘ডেটা-ব্যাংক’ প্রশাসকদের কাছে থাকতে হবে। তা না হলে নগর ব্যবস্থাপনা দুরূহ হবে। এ রকম ‘বিগ-ডেটা’ বিশ্লেষণ করেই ভবিষ্যতে নগর প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে। বিস্তারিত উপাত্ত থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো নেওয়া যায়।

এত দিন শহুরে অর্থনীতিতে মূল সংযোজনকে যতটা স্বাগত জানানো হয়েছে, মূল সংযোজনকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। গরিব বস্তিবাসীরা শহরের হাজারো কাজের অনিবার্য শ্রমশক্তি হলেও তাঁদের নিরাপদ থাকার জায়গা নেই। এ রকম মানুষদের ‘ঘরে থাকুন’ বলাটা ছিল নিষ্ফল এক আয়োজন। লকডাউন এই অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই প্রত্যাশামতো কার্যকর হয়নি।

ভীতির মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবান্তর

করোনাকালে নগরগুলোতে সবচেয়ে বিপন্ন দেখা গেছে বয়োবৃদ্ধদের। গ্রামের মতো এখানে ‘সমাজ’ নেই। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাই লকডাউনের মধ্যে চার দেয়ালে বিপদগ্রস্ত আছেন। সারা জীবন শহুরে অর্থনীতিকে জ্বালানি জুগিয়ে যাওয়া সব শ্রেণির ‘সিনিয়র সিটিজেন’দের জন্যই সরকারি-বেসরকারি সার্ভিস বিরল। বিশ্বের অনেক শহরেই চলতি সংকটে বৃদ্ধদের ওষুধ ও খাবার পৌঁছে দিতে বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। এ রকম অনেক কিছুই যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীতে নেই, সেই খোঁজ অন্তত আমরা পেয়েছি এবার। এসব শিক্ষা ‘নগরপিতা’দের জন্য ভাবনার খোরাক হয়ে থাকল।

একটা বিষয় স্পষ্ট যে অবস্থার উন্নয়নে হাত লাগানো না হলে বড় বড় শহরগুলোতে নাগরিকেরা দীর্ঘ মেয়াদে থাকার জন্য আর বিনিয়োগ করবেন না। গ্রামে কাজ না থাকলে আবারও হয়তো শহরে ঢুকবে মানুষ, কিন্তু কাজের জায়গাটির প্রতি দরদ ও ভরসা গড়ে উঠবে না। সংকটকালে পালানোর জায়গা গড়বেন সবাই অন্যত্র। করোনাকালের মেগাসিটি মহাভয় দেখিয়েছে। স্থায়ী ভীতির মধ্যে প্রাণশক্তি মরে যায়। সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করা অবান্তর। অর্থনীতি ও স্বস্তি—উভয়কে বাঁচাতে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন লাগবে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক