করোনায় স্বজন হারানোরা কেমন আছেন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গতকাল ১৮ জুন পর্যন্ত সর্বমোট ১৩ হাজার ৩৯৯ জন বাংলাদেশি করোনায় মারা গেছেন। করোনায় মৃত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আরও কিছু বেশি হতে পারে। উল্লেখ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত মানুষের সংখ্যা পুনর্নির্ধারণের ফলে সংখ্যা বেড়েছে। ইন্ডিয়া টুডের সংবাদ থেকে জানা যায়, বিহার হাইকোর্টের নির্দেশিত অডিটের পর বিহারের রাজ্য সরকার মৃত মানুষের সংখ্যা ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে প্রাপ্ত উপাত্ত অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ পুরুষ এবং ২৮ শতাংশ নারী। বয়স বিবেচনায় মৃতের হার যথাক্রমে ষাটোর্ধ্ব ৫৭ শতাংশ, ৪২ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৬০ বছর এবং ১ শতাংশ মৃত মানুষের বয়স ২০ বছরের কম। উপাত্তগুলো একটু বিশ্লেষণ করলে এর মানবিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তাৎপর্য স্পষ্ট হবে।

ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের বিপুল সংখ্যায় মৃত্যুর কারণে অনেক শিশুই দাদা, দাদি, নানা, নানির আদরবঞ্চিত হবে। আবার মৃত ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৬০ বছর থেকে বোঝা যায়, তাঁরা কর্মক্ষম ও পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিলেন। যদিও বয়স বিবেচনায় নারী মৃত্যুর হার উল্লেখ করা হয়নি, তবু অনুমান করি, তাঁদের অনেকেই ছিলেন মা, তাঁদের হারিয়ে পরিবারগুলোয় অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছে।

বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন এখন ক্রোনি পুঁজিবাদ ও মেগা প্রকল্পের ভারে অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে পড়েছে। তবে এখনো এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা আবার শুরু করার সময় পার হয়ে যায়নি

উপাত্ত থেকে জানা যায় না যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মা–বাবা দুজনের মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে কত শিশু অনাথ হয়েছে। সিএনএন সূত্রে জানা যায়, ভারতে এ ধরনের অনাথ শিশুর সংখ্যা কমপক্ষে ৫৭৭। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অভিভাবকহীন এসব শিশুকে পাচার করা হতে পারে। প্রতিবেদনটিতে মা–বাবা দুজনকে হারানোর পর দেভিকা নামের একজন তরুণী কীভাবে তাঁর পাঁচ সহোদরের আয় ও দেখভালের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা করা হয়েছে।

করোনায় মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা তাই কেবল একটি সংখ্যা বা উপাত্ত নয়, এর ব্যাপক মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। অন্য সবার মতো আমিও করোনায় প্রিয়জন হারিয়েছি। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তবে তাঁদের অধিকাংশের জীবনেই দুর্দিন নেমে এসেছে। মৃত্যুপরবর্তী সহানুভূতি ও সহযোগিতার ধারা এখন ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে এখন তাঁরা সহায়হীন হয়ে পড়েছেন। এমনটিই হওয়ার কথা এবং স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত শোক ও সহানুভূতির ভান্ডার কোথাও অফুরন্ত নয়। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হয়ে থাকে।

বিলাতের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিপর্যয়ের পর সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে এগিয়ে আসে, তা আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। আমার মেজ বোনের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্বামী হঠাৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁদের দুই সন্তান তখনো শিশু। রসায়নশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হলেও আমার বোন কেবল তার শিশুসন্তানদের দেখভাল করত। আমি তখন বোস্টনে, ছাত্র। খবর পেয়েই আমি প্লেনে চেপে লন্ডন পৌঁছাই। সেখানে দেখি, একের পর এক সরকারি দপ্তর, পৌরসভা থেকে লোক আসছেন। দাফন–কাফন কোথায় হবে, কোনো আর্থিক সহায়তা লাগবে কি না জানতে চাইলেন। এরপর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ডাক্তার এলেন, কারও শারীরিক কোনো অসুবিধা আছে কি না দেখার জন্য। মৃত ব্যক্তির সামাজিক সুরক্ষা বিমা সম্পর্কে, বাড়ির বিমা সম্পর্কে জানতে এল আরেক দল। স্কুল থেকে শিক্ষকেরা এলেন বাচ্চাদের পড়াশোনা ও স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা কী, এসব খবর নিতে। সবশেষে এলেন মনস্তত্ত্ববিদ, বাবাকে হারিয়ে শিশুরা ট্রমার শিকার হয়েছে কি না, তা জানতে। সবারই এক কথা, আমরা পাশে আছি। বিপর্যয় তোমাদের পারিবারিক হলেও রাষ্ট্র ও সমাজ তোমাদের পাশে আছে। এ সময় আমি নিজেও দেখি ও অনুধাবন করি, একজন ব্যক্তির মৃত্যুতে একটি পরিবার কীভাবে অসহায় হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে করোনায় মৃতদের সহায়তা

যত দূর জানি, কেবল সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী দায়িত্ব পালনকালে মারা গেলে তাঁদের জন্য আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাফন ও দাফন বিষয়ে সহায়তা করেছে। কোথাও কোথাও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত ব্যক্তির পরিবারের শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ বা হ্রাস করা হয়েছে। যখন এ লেখা লিখছি, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জানান, তাঁর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহৃদয় হয়ে এক বছরের ফি মওকুফ করেছে। কিন্তু তাঁর পড়াশোনার আরও দুই বছর বাকি। পরিবারটিকে এখন এ অর্থ সংস্থানের অনিশ্চয়তা নিয়েই বাকি দিন কাটাতে হবে। মৃত ব্যক্তির কর্মস্থল থেকে প্রাপ্য পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার, সিটি করপোরেশন, সমাজসেবা মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে সমন্বিত কোনো উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পারিনি।

করণীয় কী

এক. প্রথমেই জরিপের মাধ্যমে মৃত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে হবে, যাতে বিহার রাজ্য সরকারের মতো মৃত মানুষের সংখ্যা পুনর্নির্ধারণ না করতে হয়। দুই. মৃত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রোফাইলসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তিন. পরিবারগুলোর প্রয়োজন, যেমন বাসস্থান, আহার, পোশাক, শিক্ষা ও শারীরিক–মানসিক স্বাস্থ্যের ও অন্যান্য ন্যূনতম প্রয়োজন নির্ধারণ করতে হবে। চার. অনাথ শিশুদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাঁচ. ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম সব পরিবারকে সহায়তা করতে হবে। পরিবারগুলো যাতে করোনাপূর্ববর্তী নিজ নিজ জীবনমানের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। এ কাজ করতে হবে যত দিন না পরিবারটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

আশার কথা

প্রথমত, আমাদের করোনার মৃত্যুর সংখ্যা এখনো বেশি বড় নয়। এ ছাড়া সবার সব সহায়তা প্রয়োজন হবে, এমনও নয়। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মৃত মানুষের অধিকাংশই—৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ ঢাকা বিভাগের এবং প্রায় ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে, বাকি ২৫ শতাংশ অন্য বাকি ৬ বিভাগে। আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য নিলে দেখা যাবে, মৃত মানুষের অধিকাংশই বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার। যেখান থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া সহজ। তাই এ–সংক্রান্ত জরিপ ও সহায়তা প্রদান—কোনোটাই কঠিন নয়। দ্বিতীয়ত, এখনো বেশি সময় পার হয়নি। তাই তথ্য পাওয়া এখনো কঠিন হবে না।

কে করবে এ কাজ

সরকার ও স্থানীয় সরকার এ কাজের নেতৃত্বে থাকবে। তবে নাগরিক সমাজ, এনজিও, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এমনকি করপোরেট সেক্টর ও তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে।

বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন এখন ক্রোনি পুঁজিবাদ ও মেগা প্রকল্পের ভারে অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে পড়েছে। তবে এখনো এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা আবার শুরু করার সময় পার হয়ে যায়নি। তাই করোনায় স্বজন হারানো ভাগ্যাহত পরিবারগুলো নিয়েই এটা শুরু হোক। রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবারগুলোকে বলুক, দুর্ভাগ্য আপনাদের হলেও আমরা আপনাদের পাশে আছি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ