কর্মসংস্থানের সুযোগ ছাড়া সামাজিক ন্যায়বিচার কতটা সম্ভব?

করোনা মহামারির শুরুর দিকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে চলে যান। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান না থাকায় কর্মক্ষেত্রে অবস্থানের মতো সংগতি তাদের বেশির ভাগের ছিল না
ছবি : প্রথম আলো

২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে ফিরে যাওয়া যাক। করোনা মহামারির জন্য সারা দেশ বিধিনিষেধ। পণ্যবাহী যান ছাড়া বাকি সবকিছু বন্ধ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুরের মতো জনঘনত্বের শহরগুলোয় সংক্রমণ কেবল তখন কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়াচ্ছিল। বিধিনিষেধ ঘোষণা আর তা কার্যকর হওয়ার মাঝে সময় বাকি দু-তিন দিন। সে সময় ঢাকাসহ বড় শহর ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেল। লাখ লাখ মানুষ একযোগে ছুটলেন গ্রামের বাড়ি। যাঁরা ওই দুই দিনে যেতে পারলেন না, তাঁরা লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর যেতে শুরু করলেন। কেউ কয়েক শ মাইল হেঁটে, কেউ মালবাহী পিকআপভ্যানে চড়ে, কেউ ছুটলেন নৌকায়-ভ্যানে।

গ্রামমুখী এই জনস্রোতের প্রতি নানা ট্রলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে ওঠে। গণমাধ্যমের খবরে তাদের এই যাত্রাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করা হয়। গ্রামে ফেরা মানুষদের এই কাফেলায় নারী-শিশু-বৃদ্ধরাও ছিলেন। এই যাত্রাপথ ছিল দুর্বিষহ। তবে কেন এসব মানুষকে নিজেদের কর্মক্ষেত্র থেকে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন, তা নিয়ে পাল্টা প্রশ্নও করেছিলেন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতির দিকে ফিরে তাকাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে মাত্র ১০ থেকে ১৪ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে। অর্থাৎ তাঁদের কাজের অনেকটা নিশ্চয়তা আছে, নিয়মিত বেতন-ভাতা-বোনাসের সুবিধা আছে ও কর্মঘণ্টার সুবিধা তাঁরা পান। অর্জিত ছুটি, বিনোদন ছুটি কিংবা অবসরের পর পেনশন পান তাঁরা। আর বাদবাকি কর্মজীবীদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা, বেতন-ভাতা, মজুরির ঠিকঠিকানা নেই। তাঁরা অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী।

করোনা মহামারি শুরু হলে অনানুষ্ঠানিক খাতের এই বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। এ কারণে শহরে-নগরে, শ্রমিক অঞ্চলে থেকে খেয়েপরে জীবন ধারণ করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তাই এসব মানুষকেই জীবন বাজি রেখে ছুটতে হয়েছিল গ্রামের দিকে। ভাইরাসের চেয়ে খিদে আর বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তায় ছিল তাঁদের কাছে জীবনের বড় সত্য। করোনা মহামারি শুরুর সেই দিনগুলোয় এ চিত্র ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অধিকাংশ জায়গার। ভারতে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ দিনের পর দিন হেঁটে শত শত মাইল পেরিয়ে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে নিজেদের বাড়িতে ফিরেছেন। লকডাউন যখন আনুষ্ঠানিক খাতের কয়েক শতাংশ মানুষের ছুটি কিংবা ঘরে থাকা কিংবা ঘরে বসে অফিস করার সুযোগ এনে দিয়েছে, তখন অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত সিংহভাগ কর্মজীবীকে নিছক এক বেলার খাবার জোটানোই দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। করোনাকালে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের এই বিপরীত চিত্র তীব্র সামাজিক অসমতার বাস্তব চিত্রকে সামনে নিয়ে আসে। এ পরিস্থিতিকে জিইয়ে রেখে লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম, জাতি, বর্ণগত বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা একেবারেই অসম্ভব এক কল্পনা।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের মোট কর্মক্ষম মানুষের ৬০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি নারী, পুরুষ ও তরুণ তাঁদের জীবন নির্বাহ করেন অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে। কোভিড-১৯ মহামারিতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকদের নাজুকতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীরা আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদের তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রে পাওয়া সুবিধা অনেক খুব কম পান। বেশির ভাগ লোক অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কাজ করেন, সেটা তাদের পছন্দে করেন তা নয়, বরং আনুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ কম।

আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শান্তির প্রধানতম শর্ত সামাজিক ন্যায়বিচার। সব ধরনের বৈষম্য কমিয়ে আনতে প্রতিবছর ২০ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ ‘সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস’ পালন করে আসছে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন। দারিদ্র্য ও অসমতা কমিয়ে আনার পূর্বশর্ত হচ্ছে কর্মসংস্থানের প্রাতিষ্ঠানিকতার ওপর জোর দেওয়া।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের মোট কর্মক্ষম মানুষের ৬০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি নারী, পুরুষ ও তরুণ তাঁদের জীবন নির্বাহ করেন অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে। কোভিড-১৯ মহামারিতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকদের নাজুকতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীরা আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদের তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রে পাওয়া সুবিধা অনেক খুব কম পান। বেশির ভাগ লোক অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কাজ করেন, সেটা তাদের পছন্দে করেন তা নয়, বরং আনুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ কম।

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনায় খুব স্পষ্ট করেই সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ সম্পূর্ণ উল্টো। ফলে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান মাত্র ১০ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ হারের বিবেচনায় শুধু কম্বোডিয়া ও নেপাল বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে। (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বৈশ্বিক কর্মসংস্থান প্রবণতা-২০১৮ প্রতিবেদন)। কর্মসংস্থানে অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর এই অতিনির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য কর্মে নিয়োজিতদের দারিদ্র্য কমাতে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ করে ২০১৭ সালে। সেই জরিপের তথ্যমতে, দেশে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি কর্মসংস্থান আনুষ্ঠানিক খাতেই হয়ে থাকে। মোট ৫ কোটি ৯৫ লাখ লোক কর্মে নিয়োজিত। এর মধ্যে ৫ কোটি ২৩ লাখের কর্মসংস্থানই অনানুষ্ঠানিক।
আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সাধারণত কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নির্দেশ করে। নিয়মিত মজুরি, নিয়োগপত্র, চিকিৎসা, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকে এতে।

অন্যদিকে, অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ভেতরে ঠিকা কাজ, স্বকর্মসংস্থান, দৈনন্দিন মজুরিভিত্তিক কাজ অন্তর্ভুক্ত। দৃষ্টান্ত হিসেবে চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বেতন-ভাতা-মজুরি ও জীবনমানের চিত্র দেখা যাক। দেশের চা-শিল্পের সঙ্গে কমপক্ষে ১০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। মোট শ্রমিকের দশ ভাগের এক ভাগ নিবন্ধিত। তাঁরা দৈনিক নগদ মজুরি, রেশন, উৎসব ভাতার মতো সুবিধা পান। বাদবাকি শ্রমিকেরা কতটা দৈনিক পাতা তুলতে পারেন, সেটার ওপর মজুরি নির্ভরশীল। ২০১৯ সালের মালিক-শ্রমিক চুক্তি অনুযায়ী, একজন নিবন্ধিত চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। নগদ মজুরি ও অন্যান্য সব সুবিধা মিলিয়ে তাঁদের দৈনিক আয় ২০০ টাকার মতো। মজুরিবৈষম্যসহ অন্যান্য বঞ্চনার কারণে চা জনগোষ্ঠীর মানুষ অন্য নাগরিকদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৮ সালে বিবিএস ও ইউনিসেফের জরিপে দেখা যাচ্ছে, চা-বাগানের ৭৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সে সময় জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ শতাংশ।

করোনা মহামারিতে নতুন করে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এর পেছনেও বড় কারণ আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগে বাংলাদেশের নাজুক অবস্থান। বিবিএসের খানাজরিপ অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর করোনার সময় ২০২০ সালে তা হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

করোনা মহামারি বিশ্বকে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে বৈষম্য ও অসমতার প্রকটতা কতটা প্রবল। অক্সফামের সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হচ্ছে, করোনাকালে শতকোটিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি অতীতের যেকোনো রেকর্ড ভেঙেছে। মহামারির প্রতি ২৬ ঘণ্টায় একজন করে শতকোটিপতির জন্ম হয়েছে। এ সময়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০ অতিধনীর সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রতি সেকেন্ডে তাঁদের সম্পদ বেড়েছে ১৫ হাজার ডলার করে। বিপরীতে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের জীবনমান খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশেও করোনাকালে অতিধনীর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের রেকর্ড ভেঙেছে। বিপরীতে দারিদ্র্য পরিস্থিতি এক ধাক্কায় বেড়ে গেছে অনেকটা।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে কিশোর-তরুণসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে উচ্চারিত স্লোগান হচ্ছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। ন্যায়বিচারের এই আকাঙ্ক্ষা আসলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারহীনতারই প্রতিচ্ছবি। ন্যায়বিচারের ধারণা শুধু সংবিধান আর রাষ্ট্রীয় নীতিতে থাকলেই সেটা বাস্তবায়ন হবে না। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান ছাড়া সামাজিক ন্যায়বিচার ফাঁকা কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক