কলকাতার কলেজ স্ট্রিট আর কফি হাউস

কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিট এখন সমার্থক হয়ে গেছে
কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিট এখন সমার্থক হয়ে গেছে

কলকাতা কলেজ স্ট্রিট নামটি সুপরিচিত। মধ্য কলকাতায় এর অবস্থান। কলেজ স্ট্রিট মানে পৃথিবীর বাংলা বইয়ের বৃহত্তম বাজার। শুধু কি তাই? এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরোনো বইয়ের বাজার। আর ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার। তাই আজও গোটা উপমহাদেশে কলেজ স্ট্রিটের নাম মানুষের মুখে মুখে।
কবে থেকে এই কলেজ স্ট্রিট বইয়ের বাজারের জন্য খ্যাতি লাভ করে, তার সঠিক ইতিহাস এখনো জানা যায়নি। তবে কলকাতার বাংলা বইয়ের বৃহত্তম প্রকাশক দে’জ পাবলিশিংয়ের কর্ণধার সুধাংশু শেখর দে প্রথম আলোকে বলেন, আগে কলকাতার বইয়ের বাজার এই কলেজ স্ট্রিটে ছিল না। ছিল চিত্পুর এলাকায়। কলেজ স্ট্রিটজুড়ে যখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তখনই চিত্পুর থেকে বহু ব্যবসায়ী এই কলেজ স্ট্রিটে এসে বইয়ের দোকান খোলেন। তারপর ধীরে ধীরে কলেজ স্ট্রিট একসময় হয়ে ওঠে কলকাতার বইয়ের সেরা বাজার। এই কলেজ স্ট্রিট এলাকা ঘিরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ, যা এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (১৮১৭), হিন্দু স্কুল (১৮১৭), হেয়ার স্কুল (১৮১৮), সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭), কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১৮৫৭)। শুধু তা-ই নয়, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সেদিন এখানে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক সেই কফি হাউস, দিলখুশা কেবিন, বসন্ত কেবিন ইত্যাদি।
সুধাংশু শেখর দে আরও বলেন, এখনো তাঁরা কলকাতার বাংলা বইয়ের বাজারে শীর্ষে অবস্থান করছেন। তাঁদের রয়েছে পাঁচ হাজার টাইটেলের বই। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় রয়েছে অন্তত এক হাজার প্রকাশক আর বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে শুধু যে বাংলায়ই বই প্রকাশ হয় তা নয়, বাংলার পাশাপাশি নিয়মিত ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ওডিশি, অসমিয়া ভাষায়ও বই প্রকাশ হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েরও নানা বই প্রকাশিত হয় এই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া থেকে। তাই কলেজ স্ট্রিটজুড়ে সব সময়ই থাকে বইপ্রেমীদের ভিড়, আড্ডা। কলেজ স্ট্রিটকে আরও বিখ্যাত করেছে ঐতিহাসিক কফি হাউস।
এই কফি হাউস ছিল কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, অধ্যাপক কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আড্ডাস্থল। কে আসেননি এখানে? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবারই চরণ পড়েছে এখানে। আড্ডা দিয়েছেন এখানে। এই কফি হাউসকে নিয়েই প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে গেয়েছিলেন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি। সেই গান আজও শোনা যায় মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে।
তবে কফি হাউসের সত্যিই সেই আড্ডাটা আজ আর তেমন নেই। অনেকটাই ম্লান হয়েছে। এখনো অনেকে আসেন বটে, কিন্তু সেসব দিনের মতো আর আড্ডা জমে ওঠে না।
কথা বলি কফি হাউসের ৪০ বছরের পুরোনো কর্মী এফ ডি ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৮৮৬ সালে এই কলেজ স্ট্রিটে গড়ে ওঠে আলবার্ট হল। ১৯৪২ সালে ভারতের কফি বোর্ডের নির্দেশে এখানে প্রথম শুরু হয় কফি বিক্রি। ১৯৪৭ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই কফি দোকানের নাম বদলিয়ে রাখে কফি হাউস। সেই থেকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলে আসছে এই কফি হাউস। তবে ১৯৫৮ সালে এই কফি হাউস একবার বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকেরা এই কফি হাউস খোলার দাবি তুললে ফের ওই বছরই চালু হয়। ২০০৬ সালে সমবায় সমিতির মাধ্যমে আবার নতুন করে চালু করা হয় এই কফি হাউস। নতুন নাম দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান কফি হাউস।
এফ ডি ইসলাম বলেন, এখনো কফি হাউস তার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলছে। কফির গুণগত মান অটুট রাখার চেষ্টার ত্রুটি নেই আমাদের। এখনো এখানে মানুষ আসেন। কফি পান করেন। আড্ডাও দেন।
কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিট আজ সমার্থক হয়ে গেছে। কারণ, কলেজ স্ট্রিট যেমন বইয়ের প্রাণ, বইয়ের সূতিকাগার, তেমনি কলেজ স্ট্রিটের প্রাণ এই কফি হাউস। তাই তো দেশ-বিদেশের বিদ্বজ্জনেরা এখনো কলকাতায় এলে পা রাখেন এই কলেজ স্ট্রিটে বই কেনার জন্য আর এক কাপ কফি খেতে কফি হাউসে। এই কফি হাউসেই প্রতিবছর বইমেলা বসে। এবারও ২৫ জানুয়ারি থেকে বইমেলা শুরু হচ্ছে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।