কলহমুখর আওয়ামী লীগ ও নির্জীব বিএনপি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো


চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তারেক সোলেমান। পাননি। চারবারের নির্বাচিত এই কাউন্সিলর রাগে-ক্ষোভে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে থেকে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর পিছু ছাড়েনি। ১৮ জানুয়ারি দুরারোগ্য ব্যাধিতে সোলেমান (৬০) মৃত্যুবরণ করলে আলকরণ ওয়ার্ডে নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে। আপাতত এই এলাকায় অন্তর্দলীয় বিরোধ, এমনকি সংঘর্ষের শঙ্কা থেকে রেহাই পেল আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিষয়টি এখানে শেষ হয়নি।

এককালের ছাত্রনেতা, বর্তমানে দলের পদ-পদবিবঞ্চিত একজন রাজনীতিকের জানাজায় হাজার হাজার মানুষের ঢল রীতিমতো ভুরুতে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। চট্টগ্রামের প্রায় সব কটি দৈনিক পত্রিকার সচিত্র সংবাদের শিরোনামে ‘বিশাল’ জনতার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানাজায় উপস্থিত হয়ে আঁচ করতে পেরেছেন সোলেমানের জনপ্রিয়তা। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ছুটে গেছেন তাঁর শোকার্ত পরিবারের কাছে। অথচ তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। বেঁচে থাকলে আজ দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সোলায়মানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠত দলের ভেতরেই।

দলের সদ্য বিদায়ী ১৭ জন কাউন্সিলরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি এবারের নির্বাচনে। এর মধ্যে ১২ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে অনড় রয়েছেন। সুতরাং বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গ আসছে পরে, আগে অন্তঃকোন্দলেই সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে অন্তত ১২টি ওয়ার্ডে

প্রয়াত সদ্য বিদায়ী কাউন্সিলরের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হলো দলের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর জনপ্রিয়তাকে কতটা আমলে নিতে পেরেছেন নীতিনির্ধারকেরা, তা বোঝানোর জন্য। দলের সদ্য বিদায়ী ১৭ জন কাউন্সিলরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি এবারের নির্বাচনে। এর মধ্যে ১২ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে অনড় রয়েছেন। সুতরাং বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গ আসছে পরে, আগে অন্তঃকোন্দলেই সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে অন্তত ১২টি ওয়ার্ডে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সংঘর্ষ ঘটেছে, প্রাণও হারিয়েছেন একজন দলীয় কর্মী।

আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভবিষ্যতে দলের পদ-পদবি দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও আওয়ামী লীগের নেতারা সবাই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন কি না, সেটাই বোঝার বিষয়। নগর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির বলেছিলেন, ‘মনোনয়ন দেওয়ার সময় নগর কমিটির সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’ কৌশলে বলা হয়েছে কথাটি। এই একটি কথায় অনুক্ত অনেক কিছুই বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের যে দীর্ঘকালের বিরোধ, তার রেশ এখনো ফুরায়নি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে স্থানীয় এমপি ও উপমন্ত্রী মহিবুল হাসানের ছায়াতলে নাছির বিরোধীরা এখনো সক্রিয়।

সবচেয়ে বড় কথা, এই বিভক্ত দুটি উপদলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থই বলা চলে। এর আগেরবারের সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আ জ ম নাছিরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার কিছুদিন আগেই তিনি পেয়েছিলেন দলের নগর সাধারণ সম্পাদকের পদ। কাউন্সিলর পদেও ছিল তাঁর সমর্থকদের সংখ্যাধিক্য। এবার দেখতে পাচ্ছি ঠিক উল্টো চিত্র। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর নির্বাচিত মহিবুল হাসান চৌধুরী পেয়েছেন উপমন্ত্রীর পদ। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আ জ ম নাছির নিজে মেয়র পদে মনোনয়ন তো পানইনি, উপরন্তু অধিকাংশ কাউন্সিলর প্রার্থীই মহিবুল হাসান সমর্থিত। এই ভারসাম্যহীনতা দলের কোন্দল জিইয়ে রাখার জন্য ইন্ধন জোগায়। এভাবেই হয়তো দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন তারেক সোলেমানের মতো নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা।

নেতা-কর্মীদের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-দুঃখ ভবিষ্যতে কীভাবে সামাল দেবেন, তা নীতিনির্ধারকদের ভাবনার বিষয়, তবে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়ে এলে যে তাঁদের প্রার্থী মনোনয়নই প্রশ্নের মুখে পড়বে এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে তেমন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, এ নিয়ে এমনিতেই সন্দিহান তাঁরা। তার ওপর একই ওয়ার্ডে দলের একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দাবি করলে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে যৎকিঞ্চিত সম্ভাবনারও যে সমাপ্তি ঘটবে, এ কথা বোঝার মতো সমঝদারি তাঁদের আছে। তা সত্ত্বেও অন্তত দুটি ওয়ার্ডে বিএনপির একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানতে পেরেছি আমরা।

সরকারি দলে থাকার বাড়তি সুবিধা সর্বজনবিদিত। কিন্তু অত্যাচার-জুলুম সয়েও জনমতকে নিজের দিকে ঘোরানোর সুযোগও বিরোধী দলের হাতে থাকে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে সেই মনোবল বা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে না। এ রকম নির্জীব, নিরাসক্ত ও হতাশ সেনাদল নিয়ে যুদ্ধ জয় সত্যিই কঠিন।

আর মাত্র অল্প কয়েক দিন বাকি আছে নির্বাচনের। এই অতিমারির কালেও প্রচার-প্রচারণা, এমনকি উত্তেজনা-সংঘর্ষ কম কিছু ঘটেনি। বিএনপি মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের গাড়িবহরে অন্তত দুবার হামলা হয়েছে। পুলিশ প্রহরায় বিএনপি মেয়র প্রার্থীকে প্রচারণা করতে হচ্ছে, এমন দৃশ্য নগরবাসীর জন্য সুখকর নয়। এসব বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) অভিযোগ জানানো হলেও তদন্তের আশ্বাসের বেশি কিছু তত্পরতা ইসির পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। অবশ্য পাল্টা অভিযোগও আছে। বিএনপির নগর কার্যালয়ে একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার জন্য দুই দল পরস্পরকে দায়ী করেছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থী ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কাউন্সিলরের জয়লাভের ঘটনা আমরা এই নগরে একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছি। বিএনপি আমলে বিএনপি প্রার্থী মীর নাছিরকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মহিউদ্দিনকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম। কিন্তু কী আশ্চর্য, ইতিহাসের দিকে তাকালে যতটা উজ্জীবিত থাকার কথা, এই নির্বাচনে বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সে রকম উদ্দীপ্ত দেখা যাচ্ছে না। হারার আগে হেরে গেলে খেলাটা শুধুই ব্লেম গেমে পরিণত হতে পারে।

সম্প্রতি নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি, জোরপূর্বক ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আমরা শুনেছি। পত্রপত্রিকায় এমনকি শতভাগ ভোট প্রদানের ‘রেকর্ড’ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে কর্মীদের মধ্যে উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে বিএনপি নেতাদের। সরকারি দলে থাকার বাড়তি সুবিধা সর্বজনবিদিত। কিন্তু অত্যাচার-জুলুম সয়েও জনমতকে নিজের দিকে ঘোরানোর সুযোগও বিরোধী দলের হাতে থাকে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে সেই মনোবল বা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে না। এ রকম নির্জীব, নিরাসক্ত ও হতাশ সেনাদল নিয়ে যুদ্ধ জয় সত্যিই কঠিন।

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকলেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছায়ার আড়ালে তিনি প্রায় অদৃশ্যই ছিলেন এতকাল। সজ্জন-ভদ্রলোক হিসেবে একধরনের পরিচিতি আছে তাঁর। অন্যদিকে ডা. শাহাদাত হোসেন নগর বিএনপির সভাপতি হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘদিন (বর্তমানে আহ্বায়ক)। কারাভোগ করে নিজের একটা সংগ্রামী ভাবমূর্তিও গড়ে তুলেছেন। সুতরাং সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে ভোটের মাঠ যে একতরফা হবে না, এটা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়।