কাইয়ুম চৌধুরী: একজন আনন্দময় মানুষ

আত্মপ্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী
আত্মপ্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী

একটি বছর চলে গেল, কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের মধ্যে নেই—এ কথা কেমন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়! গত বছরের এই দিনটিতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে!
শিল্পী ছিলেন তিনি। তাঁর প্রধান পরিচয়ই এই যে তিনি রূপের অনুসন্ধানী ছিলেন। এই দেশ, দেশের মানুষ—তাদের যাপনের প্রহর, বেঁচে থাকার আনন্দ ও স্বপ্ন নিজের কল্পনায় রঞ্জিত করে রঙে ও রেখায় তিনি আজীবন রূপ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এটুকুই তাঁর সবটা নয়। শিল্পী হিসেবে কাইয়ুম চৌধুরীর বিচিত্র কৌতূহল ও সক্রিয়তা কেবলই চারুশিল্পের সীমানার মধ্যে আটকে থাকেনি। সেই সুনির্দিষ্ট সীমানাটি ছাপিয়ে তা বেরিয়ে এসেছিল মানুষের জীবন যাপনের আঙিনার ভেতরে। গ্রন্থসজ্জা, পোস্টার-পরিকল্পনা, লোগো বা নেমোনিক রচনা, কোনো সাংস্কৃতিক মেলার পরিসর-ভাবনা বা স্টল নির্মাণ, পরিধেয়-পরিকল্পনা ইত্যাদি ব্যবহারিক জীবনের নানা দৃশ্যবস্তু তাঁর হাতের ছোঁয়ায় রুচিময় হয়ে উঠত। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে কাইয়ুম চৌধুরীর ছিল প্রত্যক্ষ অবদান। বলতে গেলে, বাংলাদেশের নাগরিক দৃশ্য রুচির বিকাশে তাঁর ভূমিকাই ছিল প্রধান।
রঙিন মুদ্রণযন্ত্র প্রসারের আগে, সেই ব্লক তৈরি করে প্রচ্ছদ ছাপানোর যুগে, শুধু সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির জোরে সীমিত উপকরণ ও আয়োজনের মধ্যেও অপূর্ব সব মার্জিত পুস্তক তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে। বাংলা অক্ষর চিত্রণে তাঁর পটুত্ব ছিল অসামান্য। শুধু অক্ষর চিত্রণের বৈচিত্র্যেই তিনি একেকটি প্রচ্ছদের আলাদা আলাদা চরিত্র গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু বই তাঁর কাছে প্রচ্ছদমাত্র ছিল না, ছিল একটা সমগ্র। ফলে প্রচ্ছদের পাশাপাশি বইয়ের বাঁধাই, পুস্তানি, পুট বা মেরুদণ্ড, ইনার বা প্রারম্ভিক কয়েকটি পৃষ্ঠা, তাতে হরফের ধরন, আকার, সজ্জা—সবই ছিল তাঁর বিশেষ মনোযোগের বিষয়।
কাইয়ুম চৌধুরী রূপ অনুসন্ধান করেছেন এবং বিচিত্র রূপবন্ধ রচনা করেছেন। রূপের এই অন্বেষণের পেছনে ছিল তাঁর রসের জন্য তৃষ্ণার্ত একটি মন। রূপের সাধক ছিলেন বলে এই রস তিনি কেবল চারুশিল্প থেকে আহরণ করেননি। এ ক্ষেত্রে তাঁর মন ছিল একেবারে উন্মুক্ত। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র—প্রতিটি বিষয়েই তিনি ছিলেন তীব্রভাবে উন্মুখ।
শিল্প-সাহিত্যের কল্পনামুখর জগতের দিকে কাইয়ুম চৌধুরীর কৈশোর উন্মিলিত হওয়ার পেছনে তাঁর বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরীর ভূমিকা ছিল। কলকাতা থেকে তাঁদের বাড়িতে আসত বিচিত্র পত্রপত্রিকা এবং সিগনেট প্রেস, দেবসাহিত্য কুটিরসহ অন্যান্য রুচিশীল প্রকাশনীর বই। সেসব বইপত্রের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ হিসেবে মুদ্রিত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সমর দে বা প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি তাঁর মধ্যে শিল্পী হওয়ার বাসনা জাগিয়ে তোলে। এগুলোতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, হেমেন্দ্রকুমার রায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বা বুদ্ধদেব বসুর মতো লেখকের গল্প-উপন্যাসও তাঁর চিত্তের উদ্বোধনে মোটেই কম ভূমিকা রাখেনি।
সংগীতের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা ছিল দুর্বার। ১৯২১-২২ সালে কাইয়ুম চৌধুরীর বাবা যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র, তখন ত্রিপুরার জমিদার-নন্দন ও বাংলা গানের প্রবাদপুরুষ শচীন দেববর্মন ছিলেন তাঁর সহপাঠী। সেই সূত্রে বালক বয়স থেকেই শচীনকর্তার গানের পথ ধরে ধীরে ধীরে বিচিত্র ধরনের গানে কাইয়ুম চৌধুরীর আগ্রহ গভীর হয়ে ওঠে। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ছিল গানের এক বিচিত্র ও বিপুল সম্ভার। গানের প্রতি এই তীব্র আবেগ বাংলাদেশে সংগীতের নানা উদ্যোগের সঙ্গেও তাঁকে গভীরভাবে যুক্ত করেছিল।

>বাংলা অক্ষর চিত্রণে তাঁর পটুত্ব ছিল অসামান্য। শুধু অক্ষর চিত্রণের বৈচিত্র্যেই তিনি একেকটি প্রচ্ছদের আলাদা আলাদা চরিত্র গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু বই তাঁর কাছে প্রচ্ছদমাত্র ছিল না, ছিল একটা সমগ্র

চলচ্চিত্রের প্রতিও তাঁর ছিল দারুণ টান। ছবি দেখতেন বিচিত্র রকমের। হলিউডের ১৯৫০-৬০ দশকের স্বর্ণযুগের ছবি খুবই ভালোবাসতেন। পশ্চিমের চিত্রশিল্পীদের জীবন অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্র সংগ্রহ করতেন আগ্রহ নিয়ে। তাই বলে চলচ্চিত্রের নিছক দর্শক তিনি ছিলেন না। ঢাকায় চিত্রনির্মাণের প্রায় আদিপর্ব থেকেই—সেই মাটির পাহাড়-এর চিত্রায়ণের সময়—তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কাজও করেছেন চিত্রনির্মাণের নানা অংশে—সহকারী পরিচালক হিসেবে, শিল্পনির্দেশনায়, এমনকি চিত্রনাট্য রচনার প্রক্রিয়াতেও।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচিত ১৯৫০-এর দশক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখার অমোচনীয় চিহ্নটি আঁকতে শুরু করে। এ সময় থেকে আমাদের আত্মপরিচয় হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চরিত্রটি রূপায়িত হতে শুরু করে, দ্রুতই তা বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠবে। চিত্রকর, সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রকার হিসেবে এই দশকের যে তরুণ দলের হাতে আত্মপরিচয়ের এ চিহ্ন আঁকা হচ্ছিল, কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন তাঁদের একজন।
মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ের সেই রাজনৈতিক লড়াই একটি ঐতিহাসিক পরিণতি পায়। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তার এক সফল পরিণাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক নির্মাণের তো সফল পরিণতি বলে কিছু নেই। এ এক অন্তহীন প্রবাহ। সেই সজীব প্রবাহের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরীর যোগ কখনোই শিথিল হয়নি।
নানা শিল্পমাধ্যমের প্রতি কাইয়ুম চৌধুরীর আগ্রহ তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর আর যে গুণের কথাটি বলা দরকার, সে তাঁর লেখালেখি। শেষ জীবনে, খেলাচ্ছলে প্রায় যেন বা পাবলো পিকাসোর মতো, নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছিলেন কবিতায় ও ছড়ায়। কাইয়ুম চৌধুরী সে অর্থে কখনো সাহিত্যিক হওয়ার সাধনা করেননি। কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে তিনি লিখে গেছেন আজীবন। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা সেই সব গদ্যের বিষয়, এককথায় বলতে গেলে, তাঁর বিচিত্র শিল্প উপভোগ। তিনি লিখেছেন চিত্রকলা, সাহিত্য, গান, চলচ্চিত্র নিয়ে; লিখেছেন এসব শিল্পমাধ্যমে যাঁরা আমাদের মন গড়ে তুলেছেন, আমাদের সাংস্কৃতিক আকুতিকে ভাষা দিয়েছেন, যাঁরা আমাদের নায়ক, তাঁদের নিয়ে; লিখেছেন আমাদের নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ, আয়োজন ও সংগ্রামের মর্ম নিয়ে।
এসব লেখায় কাইয়ুম চৌধুরীর গদ্য কেবল অনুপম নয়, বিষয় ছাপিয়ে সে গদ্য পড়ারও একটা আলাদা আনন্দ আছে। এ গদ্যের স্বাদ আলাদা। সেখানে তিনি নিজের একটি স্বাতন্ত্র্য পরিচয় রেখেছেন।
প্রকাশনার শুরু থেকে প্রথম আলো আর কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। প্রথম আলোর তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এর পাতায় পাতায় তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের স্পর্শ লেগে আছে। তিনি এর মূল লোগো এঁকেছেন, পৃষ্ঠাসজ্জার টেম্পলেট তৈরি করেছেন, এর অজস্র লোগো ও নেমোনিক তাঁর হাতে গড়া। তাঁকে ছাড়া প্রথম আলোর কোনো ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাসজ্জার কথা কল্পনাও করা যেত না। প্রথম আলো ও প্রথমা প্রকাশনের নানা প্রচ্ছদ, স্টল, নিমন্ত্রণপত্র, স্টিকার, প্রচারপত্র ইত্যাদিতে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা।
কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে প্রথম আলোর ঋণ কখনোই শোধ হওয়ার নয়। আজ তাঁর মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকীতে তাঁকে জানাই অনিঃশেষ শ্রদ্ধা।
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক৷