কাচের পর্দায় আটকা জীবনে চোখ হারাচ্ছে শিশুরা

চিকিৎসকদের মতে, টাচ স্ক্রিন ফোন কিংবা ট্যাবলেট ব্যবহার করার সময় শিশুদের আঙুলের পেশি সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না।
প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

করোনায় ঘরবন্দী হওয়ার অনেক আগে থেকেই শিশুকে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, কম্পিউটার দিয়ে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা আমাদের কম ছিল না। এসব আসার আগে শিশুকে টেলিভিশনে আটকে রেখে তাদের ‘ঝামেলা’ থেকে বাঁচার চেষ্টা করতাম আমরা। চ্যানেল, কেব্‌ল টিভি আসার আগে সিনেমার গান আর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল মুখস্থ করতে করতে ভাত খেত শিশু। চ্যানেল আসার পর কার্টুন দেখতে দেখতে শিশু তার শৈশবচর্চা ভুলে কার্টুনের ঢঙে চলাফেরা আর কথা বলা রপ্ত করল। মা-বাবা আহ্লাদে আটখানা। এসবের কোনোটিতেই আমাদের কপালে ভাঁজ পড়েনি বরং এসব নিয়ে আমাদের গর্ব কম ছিল না।

করোনা ভর করার পর সব নির্ভরতা চলে গেল স্মার্ট, সেলফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ আর অনলাইন কম্পিউটারের ওপর। শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিকে শুরু হলো অনলাইন পাঠ। এসব পাঠের চক্রে পড়ে শিশু এখন ঘুম থেকে উঠে টুথব্রাশ খোঁজে না। খোঁজে সেলফোন। অপলক তাকিয়ে থাকা কাচের পর্দায়। মনিটরে, স্ক্রিনে।

শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিট্রিও-রেটিনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিক রেজা আলী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শিশু রোগী এখন বেশি বেশি আসছে। করোনার আগে এমন অবস্থা ছিল না। তারা আসছে চোখের জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ পিটপিট করা, চোখ দিয়ে পানি পড়া—এসব অভিযোগ নিয়ে।

করোনার বাস্তবতা আর জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি আমলে নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা, এক বছরের নিচের শিশুদের নাগালের মধ্যে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস রাখা যাবে না, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই ডিজিটাল পর্দায় না তাকায়। তাদের জন্য ‘নো স্ক্রিন টাইম’। দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের জন্য বরাদ্দ বড়জোর দিনে এক ঘণ্টা। এরপর সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সেসব মানছে কে?

করোনার বাস্তবতা আর জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি আমলে নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা, এক বছরের নিচের শিশুদের নাগালের মধ্যে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস রাখা যাবে না, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই ডিজিটাল পর্দায় না তাকায়। তাদের জন্য ‘নো স্ক্রিন টাইম’। দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের জন্য বরাদ্দ বড়জোর দিনে এক ঘণ্টা। এরপর সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সেসব মানছে কে?

চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, করোনার সময়ে চোখের সমস্যা নিয়ে আসা শিশুদের বয়সের হিসাবে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

১. চার থেকে ছয় বছরের শিশু, যাদের আগে কখনো চোখ নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু এখন ঘন ঘন চোখের পাপড়ি ফেলছে, চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, চোখব্যথা-মাথাব্যথায় ভুগছে।

২. দ্বিতীয় দলে ফেলা যায় ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুদের, যারা অনলাইনে ক্লাস করছে। অনেকক্ষণ একনাগাড়ে এক উজ্জ্বল পর্দার দিকে জানমন দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। আগে কখনো চশমা লাগেনি, এমন অনেকের এখন চশমা লাগছে। আর আগের চশমাদারদের পাওয়ার বদলে গেছে। অনেকেরই চোখে শুষ্কতা দেখা দিয়েছে। চোখব্যথা তো আছেই।

শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তারিক রেজা আলী মনে করেন, করোনা বাস্তবতা যত কঠিন হোক না কেন, কোনোভাবেই শিশু যেন একনাগাড়ে কম্পিউটার বা কোনো ডিভাইসের সামনে না থাকে, অভিভাবক আর শিক্ষকদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর তাকে উঠে চোখকে বিশ্রাম দিতে হবে। ২০ মিনিট পরপর অন্তত ২০-৩০ সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ রাখতে হবে। তাহলে চোখের ওপর চাপ অনেকটা কমবে।

শিশুদের আর যেসব ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে

ভার্চ্যুয়াল জগতের প্রতি আসক্তি: ইউনিসেফ পরিচালিত এক গবেষণা বলছে, দেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর প্রতি তিনজনের একজন শিশু। সাত-আট বছরের এক শিশু গড়গড় করে জানিয়ে দিল, ‘খাওয়ার সময় দেখি, ঘুমানোর সময় দেখি। আমার দেখতে খুব ভালো লাগে, তাই দেখি।’ মাদকের চেয়ে ক্ষতিকর মুঠোফোননির্ভরতার কারণে শিশুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বাস্তব জগৎ থেকে।

প্রতিবন্ধিতা: চিকিৎসকদের মতে, টাচ স্ক্রিন ফোন কিংবা ট্যাবলেট ব্যবহার করার সময় শিশুদের আঙুলের পেশি সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। আঙুলের জোর বাড়ে না। ফলে তারা পেনসিল ধরতে গেলে আঙুলে শক্তি পায় না। আঙুল সঠিকভাবে নড়াচড়াও করাতে পারে না।

স্থূলতা: শিশুরা বেশির ভাগ সময় টেলিভিশন, মুঠোফোন ও কম্পিউটারের পর্দার সামনে বসে থাকতে থাকতে অলসতায় ভোগে। বাড়ির বাইরে গিয়ে খেলাধুলা বা হাঁটাচলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সোফায় বা বিছানায় বসে ভিডিও গেম খেলতে বা অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় ঘরের মধ্যেও তাদের চলাফেরা থাকে না, ফলে মুটিয়ে যেতে থাকে।

মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা: কাচের পর্দায় বন্দী শিশুরা আগের যেকোনো সময়ের থেকে এখন অনেক বেশি মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। অনেকে হতাশা, উদ্বেগ, ভয়, বিচ্ছিন্নতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিসহ নানা মানসিক জটিলতায় ভুগছে।

অশ্লীলতায় আসক্তি: ইন্টারনেট একটি শক্তিশালী তবে লাগামহীন প্রযুক্তি, যা ব্যবহারকারীকে একটি অযাচিত গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে। অনেক ছেলেমেয়ে কখনো ভুল করে আবার কখনো কৌতূহলের বশে আপত্তিজনক ভিডিও এবং ফটো দেখতে দেখতে একসময় পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। এ রকম হলে তা তাদের মানসিক এবং যৌনস্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।

তাহলে পথ কী?

একজন অভিভাবক জানিয়েছেন, তাকে (শিশুকে) মুঠোফোন রাখতে বললেই উত্তর আসে, ‘তাহলে আমার সঙ্গে খেলো।’ শিশুর এই বাক্যের মধ্যেই বর্তমান পরিস্থিতির সমাধান সূত্র আছে। শিশুদের ডাকের অপেক্ষায় না থেকে বড়দের সক্রিয় সময় দিতে হবে। শিশুর কথা শুনতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে মনপ্রাণ দিয়ে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]